হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে সীমান্তে ‘শেরপুর ফেরিঘাট’ নামে একটা জায়গা আছে। একসময় অনেকের কাছে স্থানটির একটা জমজমাট পরিচয় ছিল, এ নামেই স্থানটিকে ডাকা হয়েছে। অনেকের মনে সেই পুরোনো নামটি আদরের হয়ে আছে, মনে গেঁথে আছে। সময়ে-অসময়ে মনে পড়ে, স্মৃতিকাতর করে। এখনো স্থানটির ডাকনাম সেই একই আছে, শুধু নেই ঘাটজুড়ে গাড়ি পারাপার, লঞ্চ আসা-যাওয়ার হাঁকডাক, হইচই, ছোটাছুটি। সময়ের সঙ্গে স্থানটি তার পুরোনো চেহারা হারিয়েছে। ইতিহাসের এক টুকরো অংশ হয়ে আছে।
বহু বছর আগে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল এই শেরপুর ফেরিঘাট, নৌবন্দর। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আসা-যাওয়ার পথে কুশিয়ারা নদী পারাপারে এই স্থানের দেখা মেলে। এই নদীর ঘাটে প্রথমে ছিল জুড়িন্দা নৌকা (জোড়া লাগানো দুই নৌকা), তারপর ফেরি। তা দিয়েই এপার-ওপার হয়েছে গাড়ি, পার হয়েছেন মানুষ। এই ‘শেরপুর ফেরিঘাট’ থেকে কুশিয়ারা নদীতে উজান-ভাটি চলাচল করেছে যাত্রীবাহী লঞ্চ, পণ্যবাহী কার্গো। দূরদেশের ছোট-বড় জাহাজ এসে ভিড়েছে এই শেরপুর নৌবন্দরে, ফেরিঘাটে।
শনিবার শেরপুর ফেরিঘাট ঘুরে দেখা গেছে, স্থানটিতে জুড়িন্দা নাও কিংবা ইঞ্জিনের ফেরি নোঙরের কোনো চিহ্ন আর নেই। এখানে একদিন একটা ঘাট ছিল, এই ঘাট দিয়ে দিন–রাত শত শত গাড়ি পারাপার হয়েছে, ভেঁপু বাজিয়ে ভাটির দিকে ছেড়ে গেছে লঞ্চ, ভাটি থেকে ফিরে এসে ঘাটে নোঙর করেছে; সে রকম বোঝার মতো কিছুই আর নেই এখন। তবে আগে যেটি ছিল ফেরিঘাট রোড, সেই নামটি এখনো আছে।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুর মুক্তিযোদ্ধা চত্বরের পূর্ব দিকে গেছে ‘ফেরিঘাট সড়ক’। ওই সড়ক কিছু দূর গিয়ে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে থেমে গেছে। সেই ফেরিঘাট সড়কের দুই পাশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। ওখানে কুশিয়ারা নদীর দুই পাড় নিয়ে ছিল শেরপুর নৌবন্দর। এখনো সেখানে কিছু পুরোনো চায়ের স্টল, দোকান আছে, যা সচল ফেরিঘাটের সময়ও ছিল। তবে ফেরিঘাট বন্ধ হওয়ার পর এখন ঘাটের অংশে মাছের আড়ত গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে মাছ নিয়ে আসেন মৎস্যজীবীরা। সেই মাছ হাঁকডাক করে পাইকাররা কিনে নিয়ে যান। সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত স্থানটি মাছের ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে মুখর থাকে। এরপর এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে আসে এখানে। একসময়ের সরগরম ভাব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! স্থানটি এখন নিঃশব্দ-নীরবে কালের গর্ভে আরও অনেক কিছুর মতো হারিয়ে যাওয়ার পথে।
শেরপুর ফেরিঘাট-সংলগ্ন ব্রাহ্মণগ্রামের মো. আফিজ মিয়া বলেন, ছোটবেলা থেকেই ঘাটটি দেখে বড় হয়েছেন তাঁরা। রাত-দিন সব সময় মানুষে জমজমাট থাকত। পান-সিগারেট, আচার-চানাচুর, মৌসুমি ফল বিক্রেতার চেঁচামেচি থাকত। ঘাটকেন্দ্রিক হোটেল, নানা ধরনের দোকান ছিল। এখন নামমাত্র কিছু দোকান আছে। আগের কিছুই নেই। আগে জুড়িন্দা চলত। একসঙ্গে দুটি গাড়ি পার হতে পারত। এই জুড়িন্দার চালক ছিলেন তাঁর এক দাদা রাজা মিয়া। স্বাধীনতার অনেক পরে ইঞ্জিনচালিত ফেরি চালু হয়েছে। তখন একটি ফেরিতে আট-নয়টা গাড়ি একসঙ্গে পার হতে পারত।
ফেরিঘাটের ব্যবসায়ী ছালিক মিয়া বলেন, ‘আগের ফেরিঘাট, আর এখনকার ফেরিঘাটে অনেক পার্থক্য। হাজার হাজার মানুষ আইছে গেছে (আসা-যাওয়া করেছে)। শ-দেড় শ নৌকা নদীতে যাত্রী পারাপার করেছে। এই নৌকার মাঝি সবাই এখন অন্য পেশায় চলে গেছে। কেউ বেকার হয়ে গেছে।’
একদম ঘাটের কাছে একটি পুরোনো চা-স্টলের মালিক ফজলু মিয়া বলেন, ‘যখন ফেরিঘাট ছিল, তখন বেচাকিনি ভালো অইছে (হয়েছে)। এখন মাছের আড়তে যত সময় কেনাবেচা চলে, মানুষ থাকে। দুইটার পর নীরব অই (হয়ে) যায়।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এই শেরপুর দিয়েই গেছে। শেরপুরে কুশিয়ারা নদী সড়ককে দুই ভাগ করেছে। দূর অতীতে নৌকা দিয়ে নদী পার হয়েই মানুষ এপার-ওপার হতেন। কুশিয়ারার এক পাড় পড়েছে মৌলভীবাজারের শেরপুরে, আরেক পাড় সিলেটের আওরঙ্গপুরে। এই কুশিয়ারা নদী গিয়ে মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। এতে নৌপথে দেশ-বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল স্থানটির। সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যবোঝাই কার্গো, ছোট-বড় জাহাজ এসে ভিড়ত শেরপুর নৌবন্দরে। শেরপুর থেকে ভাটির দিকে হবিগঞ্জের মার্কুলি, আজমেরিগঞ্জ, ভৈরবের চামড়া, সুনামগঞ্জের দিরাই পর্যন্ত ৮ থেকে ১০টি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ পরে ১৯৮০ সালের দিকে বড় ফেরি এসে যুক্ত হয়েছে শেরপুর ফেরিঘাটে। স্থানটি আরও গতিশীল, চঞ্চল হয়ে ওঠে।
১৯৯০ সালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর ওপর সেতু নির্মিত ও চালু হলে ফেরিঘাট নিশ্চল হয়ে পড়ে। ফেরির আর প্রয়োজন থাকেনি। ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। খেয়া পারাপারের নৌকার মাঝিরাও পেশা হারিয়ে অন্য পেশায় চলে যান। তবে সেতু চালুর পরও বিভিন্ন ধরনের নৌ চলাচল চালু থাকে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিমেন্ট, সার নিয়ে কার্গো আসা-যাওয়া করেছে। লঞ্চ চলেছে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। সেতু হওয়ার পর কুশিয়ারা নদীর ফেরিঘাট এলাকা ভরাট হয়ে গেলে ২০১৮ সাল থেকে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় শেরপুর ফেরিঘাট, শেরপুর নৌ বন্দরটি। ধীরে ধীরে ফেরিঘাটের পন্টুন সরে গেলে এখানে একদিন ফেরিঘাট ছিল, নৌবন্দর ছিল; সেই চিহ্ন মুছে স্থানের নামটি বিস্মৃত ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
‘শ্রীহট্ট সাহিত্য সংসদ’ শেরপুরের সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই শেরপুর নৌবন্দর স্বীকৃত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পর্যন্ত শেরপুর নৌবন্দরে কলকাতা থেকে জাহাজ এসেছে। বড় বড় নৌকা, কার্গো আসত। শেরপুর ফেরিঘাট যেখানে, সেই স্থানটির নাম আফরোজগঞ্জ বাজার। কিন্তু ওই জাহাজগুলো শেরপুর নামের একটি স্থানে নোঙর করত। এ কারণে বন্দরটির নাম শেরপুর নৌবন্দর হয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের কাছে জায়গাটি মাছের আড়ত নামে পরিচিত হচ্ছে। তিনি স্থানটিকে ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করার দাবি জানান।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর