সুনামগঞ্জের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু থেকেই বিলম্ব। এই বিলম্ব যেন পিছু ছাড়ছে না। সরকারী নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজের এক মাস পেরিয়ে গেলেও বেশি ভাগ পিআইসিতে কাজও শুরু হয়নি,নেই সাইনবোর্ড,যে সকল বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে সেগুলোও ধীর গতি, করা হয়নি দুরমুজ। এদিকে জেলায় গেল কয়েক বছরের মধ্যে এবার বাঁধের কাজ ঢিমেতালে হচ্ছে দায়িত্বশীলদের গাফিলতির কারণে। অথচ বিগত বৎসর এমন সময়ে বাঁধের অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হলেও এবার তার ব্যতিক্রম বলে জানিয়েছেন কৃষকগণ।
তারা জানান, জমিতে চারা রোপণ করলেও হাজার হাজার কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বৈশাখ মাসে বোরো ধান কেটে গোলায় তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
এদিকে প্রতি বছরের মত এবারও প্রকৃত কৃষকগণ বাঁধ রক্ষার কাজ পায়নি। আর জেলার কোনো উপজেলার হাওর রক্ষা বাঁধগুলোতে কাজের দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন দেখা না যাওয়ায় উৎবেগ আর উৎকণ্ঠায় আছে,আর দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ লোক দেখানো বাঁধ পরিদর্শন করেছেন কিন্তু বাঁধে অনিয়ম ও কাজ শুরু না করার কারণে কোনো জরিমানা বা কঠোর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না অভিযোগ তুলেছেন হাওর আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,জেলার প্রতিটি উপজেলায় বিলম্বে পিআইসি গঠন,এরপর সাইট বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব,আবার মাটি কাটার ও পরিবহনের জন্য গাড়ি আসতে বিলম্ব এ সকল বিলম্বের কারণে কৃষকগণ বোরো ধানের আবাদ সময় মত শুরু করলেও আগাম বন্যায় বাঁধ ভেঙে একমাত্র ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আসছেন। সময়মতো বাঁধ না হওয়ায় আর নিম্ন মানের বাঁধে কাজের কারণে আগাম পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাঁধ ভেঙে গত ২০১৬- ২০১৭সালে সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগ বোরো পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যায়। হাওর জুড়ে শুরু হয় হাহাকার।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগ জানিয়েছে,২০২৪-২০২৫ চলতি বছর বোরো মৌসুমে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪১০হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জমির বীজতলা তৈরির কাজ শেষ করে গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে হাওরে ধান রোপণ শুরু হয়েছে। এ বছর প্রায় ৪ হাজার ৫০০কোটি টাকার ধান উৎপাদন হবে। জেলায় চলতি বোরো মওসুমে প্রায় ১৩লক্ষ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,জেলার তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরের জামলাবাজ বাঁধ,আম্বর বাঁধ,আলমখালির দক্ষিণের বাঁধ,গুরমার হাওরের ১১ ও ১২নম্বর বাঁধ,এছাড়াও মাটিয়ান হাওরের ৫টি ক্লোজারগুলো ধরুন্দ এর ক্লোজার,জামলাবাজ নদীর বাঁধ,বড়দল বাগবাড়ি কুড়ের খাল,চতুর্ভুজ ক্লোজার,পুটিমারা ক্লোজার,বড়দল বাগবাড়ি কুড়ের খাল ও পুটিমারা খালের কাজ শুরু হয়নি। শাল্লার ভান্ডা বিল হাওরের নোয়াগাঁও ক্লোজার,হরিনগর ক্লোজার বাদাকাউরি বাঁধ,ছায়ার হাওরের গইচ্চাখালি ক্লোজারসহ জেলার হাওরগুলোর বিভিন্ন ক্লোজারে কাজ শুরু না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,পিআইসি এবং পাউবো’র সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর অবহেলায় ঝুঁকিতে পড়বে এবার কৃষকের ফসল।
হাওর পাড়ের কৃষক রফিক মিয়া,কামাল উদ্দিনসহ অনেকেই অভিযোগ করে জানান, ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামত/নির্মাণ করতে প্রতি বছরেই একটি সুবিধাবাদী সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে উঠে যারা কৃষক না। কৃষকদের সামনে রেখে যাদের উদ্দেশ্যই পিআইসি বাণিজ্য করে বাঁধ নির্মাণ/মেরামতে অনিয়ম করে টাকা হাতিয়ে নেয়া। সেই সব লোকজন পিআইসি নিয়েই তালবাহানা শুরু করে আর বাঁধেও খুঁজে পাওয়া যায় না এবারও তাই হয়েছে। চুক্তিতে অ্যাক্সকেভেটর মালিকদের(মাটি কাটার লোক জনের কাছে)কাছে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে বাঁধের কাজে ব্যাপক অনিয়ম হয়। আর আগাম বন্যায় আতঙ্কে থাকতে হয় কষ্টে ফলানো ফসল নিয়ে হাওর পাড়ের লাখ লাখ কৃষকগণ কে।
এদিকে,জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধের কাজের যে অগ্রগতি রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে এর বেশির ভাগই কাগুজে কলমে,বাস্তবে অগ্রগতি কম ও হাওর রক্ষা বাঁধের কাজের ধীর গতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম কর্মীগণ। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে এই কমিটিতে থাকবেন কী না,এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন।
জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সদস্য গণমাধ্যম কর্মী দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী সভায় বলেন,আমরা ভেবেছিলাম পাঁচ আগস্টের পর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ভয় তৈরি হবে,সেটি হয়নি। এইটা খুবই দুঃখের বিষয়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে,এই কমিটিতে থাকা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মন্তব্য করেন।
জেলা প্রশাসক ড.মোহাম্মদ ইলয়াস মিয়া জানান,স্থায়ী ক্লোজারের অগ্রগতি ও বাস্তব অবস্থার প্রতিবেদন জানানো ও কেউ কাজ না করলে,ব্যবস্থা নেবে নির্দেশ দেন। ২৮ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা না থাকলে,আমাদের কারো ঘটি বাটি ঠিক থাকবে না,এটি মনে রাখতে হবে।
প্রসঙ্গত,এবারও বাঁধের কাজে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ফসল অকাল বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য নির্মিতব্য হাওর রক্ষা বাঁধের জন্য এই বছর বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১২০কোটি টাকা। এর মধ্যে তাহিরপুর প্রায় ১৩কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৬ পিআইসি গঠন করা হয়েছে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর