হবিগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায় নতুন বইয়ের জন্য হাহাকার করছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।এর মধ্যে নবীগঞ্জের ১৮২ ডঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৬৭টি বেসরকারি প্রাথমিক কিনডার গার্মেন্ট স্কুলের ক্লাসে বিঘ্ন ঘটছে। এতে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও।
বছরের প্রথম জানুয়ারি মাস শেষ। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা প্রায় দেড় মাসের ছুটি। এখনো একটি বইও হাতে পায়নি প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বই না পাওয়ায় ক্লাসে তেমন একটা উপস্থিতিও নেই শিক্ষার্থীদের।
এমনকি অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে মিলছে না অনলাইন কপি। শহর এলাকায় অভিভাবকরা নিজ খরচে অনলাইন কপি প্রিন্ট করে তাদের সন্তানদের হাতে দিলেও বঞ্চিত হচ্ছেন প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা।
গ্রামীণ এলাকার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরোনো বই দিয়ে দু-একটা ক্লাস করানো হচ্ছে। তাও আবার এক বেঞ্চে একটি বই দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে। পুরোনো বইয়ের সংকট থাকায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে দুই বেঞ্চের শিক্ষার্থীরা মিলে একটি মাত্র বই দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
শহরের শিক্ষার্থীরা খুব একটা মাদ্রাসামুখী না হলেও বই না থাকায় স্কুল বিমুখ হচ্ছে তারা। তবে অনেকে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন কপি সংগ্রহ করে পড়াশুনা শুরু করেছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা।
নবীগঞ্জের আউশকান্দি এলাকার বাসিন্দা কাজল মিয়া বলেন, বাচ্চারা পরীক্ষা দিয়ে আশায় থাকতো বছরের প্রথম দিন বই পাওয়া যাবে। কিন্তু এবার ছন্দপতনে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ করা যায় সে দিক নিয়ে ভাবতে হবে।
কম্পিউটার ও স্টেশনারি লাইব্রেরি ব্যবসায়ী রাজু আহমদ বলেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনেক অভিভাবক এসে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বইয়ের প্রথম অধ্যায় প্রিন্ট করেছেন। এখনো প্রতিদিন অনেকে এসে প্রিন্ট করছেন। যাদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে তারা সাদাকালো প্রিন্ট করছেন।
এদিকে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকার প্রাথমিকের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে শুধু প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি।
সময়মতো পাঠ্যবই সরবরাহ করতে না পারায় এসব ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। আর যেসব শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায় তাদেরকে পুরোনো বই দিয়ে পাঠদান করা হয়। ক্লাস শেষে আবার বই অফিসে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব শিক্ষকরা বলেন, পুরোনো বইও না থাকায় এক বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের একটি বই দিয়ে পাঠ করানো হয়। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে দুই বেঞ্চের শিক্ষার্থীরা মিলে একটি বই পাঠ করে।
নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি। পুরোনো বইও নেই। কয়েকটি বই থাকায় সেগুলো পাঠদানের সময় ক্লাসে নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হয়। ক্লাস শেষে আবার নিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এক বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের একটি বই দিয়ে ক্লাস করাতে হচ্ছে।
পাঠ্যবইয়ের অনলাইন কপি সরবরাহ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় অনলাইন কপি প্রিন্ট করে নিয়ে আসার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে প্রিন্ট কপিও দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা অনলাইন কপি বোঝে না, তাদের কাছে বই জরুরি।
তিনি আরও বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে নতুন বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা বই পেয়ে আসছিল। এ বছর সেই ধারাবাহিকতা না থাকায় অনেকেই ধরে নিয়েছেন বই পাবেন না। এজন্য কিছু কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে আসছে না।
উপজেলা সদরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, বই না থাকায় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা যাচ্ছে না। গড়ে ৪-৫ জন শিক্ষার্থী ক্লাসে আসে। কিছু শিক্ষার্থী মাদরাসায় চলে যাওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মাদরাসাগুলোর ব্যাপক প্রচারণা অন্যতম একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
একই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নাইমা খান কোনো বই না পেয়ে অনেকটা কান্না জর্জরিত কণ্ঠে বলেন, সরকার তো পাল্টে গেছে, ড. ইউনূসের মনে হয় বই দিতে একটু দেরি হচ্ছে৷
গতকাল বুধবার হবিগঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, জেলার ৯ উপজেলায় মাধ্যমিকে ২৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৫৯টি ও প্রাথমিকে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮৫টি বইয়ের ঘাটতি ছিল। এ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকে জেলায় ১৬ লাখ ৮ হাজার ৪১০টি বইয়ের চাহিদা ছিল এবং এ পর্যন্ত ১২ লাখ ৪২ হাজার ৭২৫টি এসেছে। এখনও ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮৫টি বইয়ের ঘাটতি রয়েছে। প্রাথমিকের প্রাক প্রাথমিকে বইয়ের চাহিদা ৫৭ হাজার ২০০টি, প্রথম শ্রেণির ২ লাখ ১১ হাজার ৬৫৯টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ২ লাখ ৭ হাজার ৫৯১টি ও তৃতীয় শ্রেণিতে ৪ লাখ ৫৯০টি বইয়ের চাহিদা ছিল। এগুলোর শতভাগই এসেছে ।
তবে চতুর্থ শ্রেণির ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৫১০টি পাঠ্যবইয়ের চাহিদা থাকলেও মাত্র ১ লাখ ৯২ হাজার ২৫৫টি এসেছে এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬০ চাহিদার বিপরীতে বই এসেছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৩০টি। ফলে এ দুই শ্রেণির জন্য আরও ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৮৫টি বই প্রয়োজন।
এদিকে, এ শিক্ষাবর্ষে জেলায় মাধ্যমিকে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য পাঠ্যবইয়ের চাহিদা ছিল ৩২ সলাখ ৫৩ হাজার ৫৯৩টি। গতকাল পর্যন্ত মাত্র ৫ লাখ ১১ হাজার ৭৩৪টি বই এসেছে এবং বিতরণ হয়েছে। ঘাটতি আরও ২৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৫৯টি। মাধ্যমিকে চাহিদার বিপরীতে মাত্র ১৭ শতাংশ বই এসেছে। তবে বাকী ৮৩ শতাংশ বই এখনও আসেনি।
নবীগঞ্জ প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রোমান মিয়া বলেন, নবীগঞ্জে ১৮২ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৭ টি কিনডার গার্মেন্টস স্কুলে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর বই দেয়া হলেও তৃতীয়,দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের ৩টি করে বই দেয়া হয়েছে। বাকি বই গুলো শিগগিরই পৌঁছে যাবে। শিক্ষকদের বলা হয়েছে গাইড অথবা শিক্ষক সহায়িকা গাইড দেখে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়ার জন্য ।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফরিদা নাজমিন বলেন, সবগুলো বই না আসায় এখনও পুরোদমে পাঠদান শুরু করা যায়নি। তবে শিগগির এ সমস্যার সমাধান হবে। কারণ- বইয়ের ছাপা চলছে। প্রতিদিনই হবিগঞ্জে বই প্রবেশ করছে। একই কথা জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম মাওলা।
তিনি আরও বলেন, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজী ও গণিত বইগুলো পাওয়া গিয়েছে। বাকিগুলো শিগগির আসবে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর