![BD24LIVE.COM](https://www.bd24live.com/bangla/public/logo-bd24live.png)
২০১৩ সালে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল চালু হওয়ার পর গত ১৩ বছরেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌপথে পণ্য পরিবহণ।
পরিবহন খরচ বেশি হওয়াসহ নানা কারণে এই রুটে পণ্য পরিবহণ যখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, তখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনের একমাত্র নৌরুটটি আবারও সচল করতে চাইছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।
এজন্য চট্টগ্রাম-পানগাঁও-চট্টগ্রাম নৌ-রুটে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারের গতি বাড়াতে বিভিন্ন ব্যবসাবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া কমানো ও অতিরিক্ত আরেকটি জেটি বরাদ্দসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বন্দরের ঝিমিয়ে পড়া কনটেইনার টার্মিনাল ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখছে কর্তৃপক্ষ।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম-পানগাঁও-চট্টগ্রাম রুটের জাহাজ ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক করতে চট্টগ্রাম বন্দরের জারিকৃত পূর্বের নির্ধারিত ভাড়ার সার্কুলারটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। এর ফলে দর কষাকষি করে এই নৌ রুটের ভাড়া নির্ধারণের সুযোগ অবারিত হল। এতে করে একদিকে ব্যয় সাশ্রয় হবে অন্যদিকে বাড়বে সেবার মান।
ব্যবসায়ীদের মতে, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় সড়ক ও রেলপথ দুই মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ করা যায়। এই দুই মাধ্যমে পণ্য পরিবহনে যেই খরচ পড়ে, নৌপথে পণ্য পরিবহনে এর চেয়ে বেশি খরচ পড়লে ব্যবসায়ীরা এই রুটে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হবে না। যদি সময় বেশি লাগে তখন খরচ কম পড়ার পরও অনেকে নৌপথে পণ্য পরিবহণ করতে চাইবেন না। তাই এই রুটকে চালু রাখতে আগে ভাড়া কমানো এবং ওই রুটে নিয়মিত জাহাজ পরিচালনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত এক সভায় পূর্বের নির্ধারিত ভাড়ার সার্কুলারটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্পোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যুগ্ম সচিব, নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, এফবিসিসিআই, ঢাকা ও চট্টগ্রাম চেম্বার, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ, শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরোওয়ারর্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন, কোস্টাল শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, অভ্যন্তরীণ জাহাজ মালিকদের একাধিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, পানগাঁওয়ে পূর্বের সেই চিত্র এখন আর নেই। শুল্কায়নে হয়রানি বন্ধে পুরো কাস্টমস কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করা হয়েছে। সব ধরনের সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে দুইটি ডেডিকেটেড বার্থ বরাদ্দ দেওয়া আছে। বাণিজ্য বাড়াতে ওপেন আইজিএম চালুর বিষয়ে এনবিআরের সাথে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের কাজে এনলিস্টেড লাইসেন্সধারীদের কেন আবার পানগাঁওয়ের জন্য আলাদা লাইসেন্স করতে হবে বা অনুমতি নিতে হবে তা কাস্টমসের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।
এসব উদ্যোগের ফলে পণ্য পরিবহনের নিরাপদ, সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী রুট হবে এই চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌ-রুট। জানা যায়, নদীপথে কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক হলে বর্তমান ভাড়ার চেয়ে ব্যাপক হ্রাস পাবে। পানগাঁও ইংল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনালের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে পূর্ব নির্ধারিত একটি জেটি ছাড়া অতিরিক্ত আরেকটি জেটি পানগাঁওগামী জাহাজের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এই বার্থিং প্রায়োরিটির কারণে আগের চেয়ে দ্বিগুণ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করা সম্ভব হবে। এই নৌরুটে বর্তমানে ১৯টি নিবন্ধিত জাহাজ রয়েছে। জাহাজগুলোকে নিয়মিত চলাচল করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কনটেইনার অপারেটরসহ অন্যান্য শিপিং লাইনগুলো নদীপথে কনটেইনার পরবিহনের জন্য পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে ২০০৫ সালে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ৬৪ একর জমিতে ১৫৪ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়। বছরে ১ লাখ ১৬ হাজার টিইউএস কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের সক্ষমতার টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১২ সালে। এরপর ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে শুরু হয় অপারেশন কার্যক্রম। কিন্তু সড়ক ও রেলপথের তুলনায় এই রুটে পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত জাহাজ পরিচালনা করায় গত কয়েক মাস ধরে ওই রুটে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। কাস্টমস জটিলতাসহ নানা অনিয়মের কারণে ব্যবসায়ীরা পণ্য আনেন না এই পানগাঁওয়ে। তাই লোকসান কাটিয়ে আলোর মুখ দেখেনি টার্মিনালটি।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে শিডিউল মেনে ২১টি কনটেইনার জাহাজ চলাচল করতো। তবে চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন জাহাজ পানগাঁও এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়ায় এবং মেরিন ট্রাস্ট-১ কলকাতা বন্দরে ডুবে যাওয়ায় এখন এই রুটে ১৯টি জাহাজ চলাচল করে। এদের প্রতিটির ধারণক্ষমতা ১২০ থেকে ১৩০ একক কনটেইনার। ছোট আকারের এই জাহাজগুলোতে পণ্য ওঠানামা করা যায় ৬ ঘণ্টার মধ্যেই। তাই এই ১৯টি জাহাজ একত্রে প্রায় আড়াই হাজার কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁওয়ে পরিবহণ করতে পারবে।
জানা যায়, পানগাঁও বন্দরের স্টোরেজ সক্ষমতা সাড়ে ৩ হাজার টিইইউএস কনটেইনার। বছরে এ বন্দর হ্যান্ডেলিং করে এক লাখ ১৬ হাজার টিইইউ কনটেইনার। পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালে ২০২৩ সালে ভিড়েছিল ১৪৭টি পণ্যবাহী জাহাজ। অর্থাৎ গড়ে প্রতিমাসে ১২টির বেশি জাহাজ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে হ্যান্ডেলিং বৃদ্ধি ও ওই টার্মিনালের অপারেশনাল কার্যক্রম গতিশীল করতে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর এবং গত ১৫ সেপ্টেম্বর দুই দফায় জাহাজ মালিক, আমদানি-রপ্তানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। এসময় তিনি পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনালকে ব্যবসাবন্ধব হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। সভায় বন্দর চেয়ারম্যান পানগাঁও টার্মিনালকে সচল করতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে আমদানি- রপ্তানিকারক, শিপিং এজেন্টকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বলেন, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সভায় আগের ভাড়া সংক্রান্ত সার্কুলারটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে চট্টগ্রাম-পানগাঁও-চট্টগ্রাম রুটের কোনো ভাড়া আর থাকবে না। এবার প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া নির্ধারণ হবে। দর কষাকষি করা যাবে এবং সেবার মান বাড়বে বলে আশা রাখি। মন্ত্রণালয় থেকে বন্দরের পূর্বের এই রুটের ভাড়া সংক্রান্ত সার্কুলারটি বাতিল করে দ্রুত একটি নতুন সার্কুলার জারি করবেন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ঢাকায় আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনওওে সড়ক ও রেলপথের পাশাপাশি নৌপথে পণ্য পরিবহণ হোক। কারণ কখনো সড়ক ও রেলপথে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হলে তখন নৌপথে পণ্য পরিবহণ করা যায়। কিন্তু নৌপথে পণ্য পরিবহনে প্রধান সমস্যা হলো খরচ। সড়ক ও রেলপথ থেকে নৌপথে খরচ বেশি হলে ব্যবসায়ীরা নৌপথে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হবে না।
রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, শুধু রপ্তানি বা আমদানি জাহাজে নজর দিলে হবে না। উভয় দিকটা যদি দেখা হয়, তাহলে জাহাজ খালি আসবে না।
সবাই লাভবান হলে ওই নদীপথ অনেক গতিশীল হবে। আর এজন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে এই রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে ভাড়া কমানো এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ দুইটা যদি ঠিক থাকে তাহলে পানগাঁও অবশ্যই গতি পাবে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর