আমি এগারো বছর চট্টগ্রাম শহরে সিভিলে ধরছি যে পোয়া,‘এসপি-তেসপি’ এদের কার সাথে কি সম্পর্ক তা আমি ভাল জানি। আমার এসপি ধরে মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ। আর আমি ধরি এক কোটি টাকা। কয়েকটি অডিওতে এভাবেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মাদক কারবারিসহ সাধারণ মানুষকে হুংকার দিতে শুনা যায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাব ইন্সপেক্টর (এইআই) বদিউল আলমকে।
প্রতিবেদকের হাতে আসা অডিওতে শুনা যায়, জামিনের দরকার নেই, আমি তোমাকে ধরবো না। কথোপকথনের অপর প্রান্তে থাকা ওই ব্যক্তিকে বলতে শুনা যায়, আমি শুধু মুন্সি-উকিলের ফিস দিয়ে জামিন হতে পারতেছি। এসময় বদিউল বলেন, আমি যদি তোমাকে ধরি, আমার বাপের জন্ম হবো না। এমন কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি আরও বলেন, পরশু চট্টগ্রাম যাবো টাকা পয়সা ভাল করে দিও। অনেক টাকা খরচ আছে; ভাই হিসেবে দিও। এতে অশ্লীল গালাগাল করতেও শুনা যায় তাকে।
জানা গেছে, দু’মাস আগে টেকনাফ থানায় তার যোগদানের পরেই বদলে যায় পুরো টেকনাফ উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চিত্র। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) থেকে শুরু করে দাম্পত্য কলহ, পারিবারিক সালিশ বা জমির বিরোধ; প্রাইভেট নোহা নিয়ে যে কারো বাড়িতে ঢুকে অভিযানের নামে হয়রানি সহ সবকিছুতেই এখন তার উপস্থিতি। টেকনাফের মানুষের মুখে মুখে এখন ঘুরছে ওসিসহ এসআই বদিউলের ‘ঘুষের কারবারের’ অভিযোগসংক্রান্ত নানা মুখরোচক কাহিনি।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, আর্থিক সচ্ছল ব্যক্তিদের অপহরণ চক্রের সদস্য ও মাদক কারবারি আখ্যায়িত করে বিভিন্ন অজুহাতে টাকা আদায় করেন বদিউল। ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য’র পাশাপাশি পান থেকে চুন খসলেই তার ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি এখন সবারই জানা। এমনকি স্থানীয় সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দলের নেতা কর্মীরাও এই কর্মকর্তার ‘ঘুষ বাণিজ্য’র শিকার হওয়ার কথা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তবে নতুন করে বিপদে পড়ার ভয়ে তাদের অধিকাংশই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
এদিকে বদিউলের ‘ঘুষ বাণিজ্য’র শিকার হওয়ার ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ এখন বড় বিপদে পড়লেও আর থানামুখী হতে চাইছে না। এরআগে এক স্কুল ছাত্রকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও ওসিসহ তার কর্মকাণ্ডে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং সর্বশেষ মাথা চড়া দিয়ে উঠা অপহরণ চক্র ঘিরে তার ‘ঘুষের বাজার’ আরও জমজমাট হয়ে উঠে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়রা।
তাদের মতে, টেকনাফে নানা পেশার নিরীহ মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের আরেক নাম সাব ইন্সপেক্টর বদিউল আলম। চাকরিজীবনে নানা স্থানে অপকর্ম সাধন করে অবশেষে টেকনাফবাসীর কাছে ওসি প্রদীপের পর মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন জনগণের ঘামঝরা টাকায় পোষিত এই পুলিশের কর্মকর্তা।
অভিযোগ উঠেছে, দাগি আসামীদের সাথে সখ্যতা, চোরাকারবারিদের সাথে যোগসাজশ, নিজের হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য অপরাধীদের ব্যবহার করে জঘন্য ঘটনা ঘটাতেও তার জুড়ি নেই। মামলা কেলেঙ্কারি, গ্রেফতার বাণিজ্য ও যাকে তাকে ধরে তল্লাশির নামে হয়রানি কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ি হাকিয়ে অভিযানের নামে যেকোনো বাড়িতে গিয়ে হানা দেওয়া তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাবাকে না পেয়ে এক স্কুল ছাত্রকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনার প্রধান চরিত্রে থাকা এসআই বদিউল দেশ জুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হলেও তার তেমন কোনো শাস্তি হতে দেখা যায় নি। তাই এবার টেকনাফে আঁটগাট বেঁধেই নেমেছেন নিজের আখের গোছানোর কাজে, তাতে কারকি সর্বনাশ হলো তা ভাবার সময় তার নেই। এমন অভিযোগ টেকনাফবাসীর।
গত ২৮ অক্টোবর রাতে উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদায় ‘জেটএনবি’ ব্রিকস নামের একটি ইটভাটা সাধা রঙের নোহা নিয়ে হাজির হয় এসআই বদিউল। এসময় ইটভাটাটির ম্যানেজার আব্দুল হককে তুলে নিয়ে যায় থানায়। রাতভর নানা টালবাহানা করে সকালে ১৮ জন বনকর্মী অপহরণ মামলা তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে প্রেরণ করেন তিনি। ভুক্তভোগী আব্দুল হকের ভাই ফাহাদের দাবি, ইটভাটাটিতে তার ভাই গত পাঁচ বছর ধরে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছে। তার বিরুদ্ধে কোন মামলা তো দূরের কথা; কোথাও কোন অভিযোগও নেই। হঠাৎ করে ভাইকে এমন মামলায় ফাঁসানোর ঘটনায় তার পুরো পরিবার হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
ফাহাদ অভিযোগ করে বলেন, ইটভাটাটির ম্যানেজার পদ থেকে আমার ভাই আব্দুল হককে সরিয়ে দিতে একটি পক্ষ নানা চক্রান্ত করে আসছিলেন। ওই পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অপহরণ চক্রের সদস্য বানান এসআই বদিউল। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ উল্লেখ না করে বনকর্মী অপহরণ মামলায় তাকে ফরোয়ার্ডিং আসামি করে আদালতে পাঠান বদিউল। যার ফলে আমাদের সামাজিক জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাঁদের, তারাই যদি আইনের বর্ম পরে সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধভাবে অপরাধবৃত্তি চালিয়ে যান, তাহলে তাদের ঠেকায় কে? এমন মন্তব্য করে স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি নোহা গাড়ি নিয়ে ‘সিভিল টিম’ দাবি করে এসআই বদিউল অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এটা বিরাট উদ্বেগের বিষয়। তিনি গাড়িটি নিয়ে নিরীহ জনসাধারণকে অসৎ উদ্দেশ্যে আয়ত্তে নিয়ে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়, তদন্ত কিংবা অভিযানের নামে কারো বাড়িতে ঢুকে হুমকি-ধামকি দেওয়া তার নিয়মিত দায়িত্ব হয়ে উঠেছে।
তাদের মতে, টেকনাফ থানায় যোগদানের পরপরই সাব ইন্সপেক্টর বদিউল মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী, ডাকাতসহ অপরাধীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। মাসোয়ারার বিনিময়ে তাকে অপরাধে অনেকটাই উৎসাহ দিয়ে থাকেন এই কর্মকর্তা। তার আচরণে সাধারণ মানুষসহ গণমাধ্যমকর্মীরা ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিবাদ করতে পারেন না। থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করেই তিনি চলেন।
প্রতিবেদকের হাতে আসা কয়েকটি সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দিনে দুপুরে একটি সাদা রঙের নোহা গাড়ি নিয়ে আলিশান বাড়ির সামনে দাঁড়ায় এসআই বদিউল। সাথে কয়েকজন কনস্টেবল নিয়ে ওইসব বাড়িতে ঢুকে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর বের হয়ে যেতে দেখা যায় তাকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেকোনো মুহূর্তে অতর্কিত অবস্থায় কারো বাড়িতে ঢুকে মাদক কারবারি, মানবপাচারকারী কিংবা অপহরণ চক্রের সদস্য আখ্যায়িত করে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করেন বদিউল।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে এসআই বদিউলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করবেন বলে হুমকি দেন।
পরে তিনি অপহরণ চক্র নিয়ে কাজ করার কারণে করেকজন মাদক কারবারির নাম উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করছেন বলে দাবি করেন।
এখন পর্যন্ত অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন, এইসব অভিযোগ তদন্ত করে যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তখন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও ভুক্তভোগীদের পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শও দেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর