
খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টরের সকল সদস্য ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা এবং দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে মাতৃভূমির সীমান্ত সুরক্ষায় প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খাগড়াছড়ি সেক্টর বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর।
পানছড়ি, বাবুছড়া, বাঘাইহাট (হাজাছড়া), মারিশ্যা এবং খাগড়াছড়ি এই ৫টি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে খাগড়াছড়ি সেক্টর সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করছে। এই অঞ্চলের প্রতিটি সীমান্তই দুর্গম পাহাড়ে বেষ্টিত।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি বিজিবি সেক্টর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উঁচু-নিচু পাহাড় ও জঙ্গল অতিক্রম করেই পৌঁছাতে হয় দুর্গম সীমান্তে। এর পর সীমান্ত পিলার পরিদর্শন, প্রতিপক্ষের সাথে যৌথ টহল, শূন্য লাইনে মার্চ এ সকল কাজ শেষে আবার পায়ে হেঁটে বিওপিতে ফেরত আসার এ কার্যক্রম চলে প্রতিদিন, সপ্তাহ, মাস, বছর পেরিয়ে যুগ যুগ ধরে।
সীমান্তরক্ষীদের পরিবারগুলো অনেক দূরে অধির আগ্রহে বসে থাকে পিতা, স্বামী, পুত্র বা আপনজনের আগমনের অপেক্ষায়। ঈদ পার্বনের মত আনন্দের অনুষ্ঠানগুলিতে গড় হাজির এ অকুতোভয় সীমান্তরক্ষীরা অন্যের আনন্দ নিশ্চিত করতে গিয়ে নিজের আনন্দ জলাঞ্জলি দেয় অকাতরে।
খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা থানার বান্দরসিং বিওপির বগাপাড়া হতে রাঙ্গামাটি জেলার বরকল থানার মাঝিপাড়া বিওপির থলছড়া পাড়া পর্যন্ত ২৬০ কি. মি. বিস্তীর্ণ সীমান্তের নির্ভীক প্রহরী বিজিবি। এই বিস্তীর্ণ সীমানার অনেক অংশই কয়েক বছর পূর্বেও অরক্ষিত ছিল। অনেক বিওপি আছে যেখানে বিজিবি সদস্যদের ৫-৬ দিন পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয়। হেলিকপ্টার ছাড়া সেখানে রসদ পৌঁছানো যায় না।
কিন্তু শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিজিবি সদস্যগণ দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তবে আশার বিষয় হলো সীমান্ত সড়ক নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই কার্যক্রমেও বিজিবি নিরাপত্তা প্রদান করে আসছে। এই সীমান্ত সড়ক সম্পন্ন হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
গত ১ বছরে খাগড়াছড়ি সেক্টর ৬৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা মূল্যের অবৈধ ভারতীয় পণ্য সীমান্ত এলাকা হতে আটক করেছে। যার মধ্যে শাড়ি, কম্বল, চা পাতা, চিনি, জিরা, রসুন, মোবাইল, কসমেটিক্স সামগ্রী, কীটনাশক, গরু, সিগারেট, বাংলাদেশি কাঠ এবং সুপারি ইত্যাদি রয়েছে।
সম্প্রতি একটি মহল পাহাড়ে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি এই ধরনের অপতৎপরতা রোধে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লব এবং তৎপরবর্তী আদিবাসী ইস্যুটি বিজিবি দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করছে।
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর হতে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়ী-বাঙ্গালী সংঘর্ষের সময় ৬৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন থেকে দায়িত্ব পালন করে।
গত ১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মো. সোহেল রানা’কে একজন ত্রিপুরা ছাত্রীর শ্লীলতাহানীর অভিযোগ তুলে উগ্র পাহাড়ি ছাত্ররা তার অফিস কক্ষে পিটিয়ে হত্যা করে।
উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি শহর ও আশেপাশের এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং পাহাড়ী-বাঙ্গালী দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। বিজিবি উক্ত দাঙ্গা দমনে মবের সামনে থেকে বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে।
এছাড়াও ১৮-২২ সেপ্টেম্বর দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজারস্থ লারমা স্কয়ারে ৮ প্লাটুন বিজিবি মোতয়েন থেকে দায়িত্ব পালন করছে।
অন্যান্য এলাকার মতো এই সেক্টরের বিজিবি সদস্যগণও সীমান্ত সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি নানা জনসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এগুলোর মধ্যে বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দুঃস্থ ও অনগ্রসর জনসাধারণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ প্রদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, আর্থিক সহায়তা, শিক্ষা ও খেলাধুলার উপকরণ, সেলাই মেশিন, গবাদিপশু, গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গেল বছরের ১৬-১৮ জুন সাজেক ইউপির দুর্গম নিউ থাংনাং এবং শিয়ালদাহপাড়া এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে সেখানে খাগড়াছড়ি সেক্টরের ৫৪ বিজিবি মেডিক্যাল ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে ৩০০ জন অসুস্থ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সুস্থ করে তোলে। জনকল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে ২৮টি মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ৩ হাজার ৯৩৩ জন প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
বন্যার্ত ১ হজার ৪৯ টি পরিবারকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ১ হাজার ৭১০ জন শীতার্ত দরিদ্র মানুষকে কম্বল/শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। ২ হাজার ৭৬১ জনকে সর্বমোট-১৫ লাখ ১৬ হাজার ১৫০ টাকা মূল্যের শিক্ষা উপকরণ, খেলাধুলার সরঞ্জাম এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ খাগড়াছড়ি সেক্টর সদর দপ্তরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. আব্দুল মোত্তাকিম বলেন, 'সেক্টরের অধীনস্থ প্রতিটি সদস্য নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও অবিচল দেশপ্রেমের সাথে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে।
পাশাপাশি পাহাড়ি-বাঙ্গালী ইস্যুতে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করছে। পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতি সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিজিবি।
সম্প্রতি একটি মহল পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির পায়তারা করছে। তাদের এই অপকৌশল প্রতিরোধে বিজিবি সদা জাগ্রত রয়েছে। নিয়মিত অবৈধ চোরাচালান এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে বিজিবি খাগড়াছড়ি সেক্টর সর্বদা সোচ্চার রয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।'
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর