
ঝিনাইদহ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান যোগদানের পর থেকে বদলে গেছে চিকিৎসা সেবার মান। হাসপাতালটিতে জেলার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে সকল অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়মমাফিক চিকিৎসা দিতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। সরকারি ঔষধ নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে দামি ইনজেকশন গুলো মিলছে হাসপাতালটিতে। ভালো খাবার দেওয়ার পাশাপাশি হাসপাতাল আঙ্গিনায় বসানো হয়েছে ফুলের টপ। নতুন করে ৪ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা রোগীদের পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ মিলছে সার্বিক বিষয়ে সেবা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ সুশীল সমাজে প্রশংসায় ভাঁসছেন তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ঝিনাইদহ পৌর এলাকার হায়দার আলী নামের এক ব্যক্তি তার ফেসবুকে লিখেছেন, এখন থেকে বেশ কয়েক বছর পূর্বে ঝিনাইদহ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম। সেসময় সেবা পাওয়ার জন্য ডাক্তার, নার্স এবং কর্মচারীদের কাছে বারবার নিবেদন করেও ফল পাওয়া কষ্ট হতো। কোন ঔষধ পাওয়া যেত না, খুব বেশি হলেও কয়েকটা প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন তাছাড়া অন্যান্য দু’একটা সস্তা ঔষধ পাওয়া যেত। আজ পাঁচদিন হলো, বেশ শারীরিক জটিলতা নিয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখনও পর্যন্ত কাউকেই কিছু বলতে হয়নি। প্রায় ১১ প্রকার ঔষধ লাগছে, কোন ঔষধ বাইরে থেকে কিনতে হয়নি। ওই সব ঔষধের মধ্যে একটির দাম ১৩০০/টাকা যা প্রতিদিন ৫টি করে লাগে। যাদুটা কি বুঝলাম না, কেউ বুঝলে জানাবেন?
এমনি ভাবে চিকিৎসা নিতে আসা মিঠুন শিকদার নামে এক রোগী জানান, হাসপাতালের অনেক অনিয়ম এখন প্রকাশ্যে এসেছে। যা রোগীসহ অনেকেই অবগত। যার ফলে চুরি, সিন্ডিকেটসহ সকল অনিয়ম এখন বন্ধ করেছে নতুন তত্ত্বাবধায়ক। আমি সেবার মান বৃদ্ধি হওয়ায় সন্তুষ্ট প্রকাশ করছি।
খোজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালে মোট ডাক্তারের প্রয়োজন ৬৪ জনের। তারমধ্যে ২৫ টি পদ শূন্য রয়েছে। ৩৯ জন ডাক্তার দ্বারা হাসপাতালটি পরিচালিত করা হচ্ছে। যার ফলে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়াটা ডাক্তারদের পক্ষে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাসহ সিনিয়র স্টাফ নার্স এবং অন্যান্য পদে পদসংখ্যা ৯১ জন। তারমধ্যে ৭১ জন কর্মরত, বাকি ২৪টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়াও ৩য়, ৪র্থ শ্রেণী ও আউট সোর্সিং এ অনেক পদ শূন্য রয়েছে।
জানা যায়, ২০২১ সালে ঝিনাইদহ ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালটি ২৫০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীতকরণ করা হয়। তার পর থেকে সরকারের পর্যাপ্ত বাজেট থাকলেও নানা অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট নতুন তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান যোগদানের পর সকল সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়। তারপর থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তিনি ন্যায়ের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালটির আঙ্গিনায় বসানো হয়েছে ফুলের টপ। স্যাপটিক ট্যাংক, টয়লেট পরিষ্কার করা, বিল্ডিংয়ের গ্লাস লাগানো, খুলে পড়া টাইলস বসানো, মেইন গেইট লাগানো, খাবারের মান উন্নত, নষ্ট হওয়া সিসি ক্যামেরা মেরামত এর কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চিকিৎসা বহি তৈরী করা হয়েছে। সকলের চিকিৎসা বহি এর মাধ্যমে তারা প্রয়োজন হলে ঔষধ সংগ্রহ করবেন যা তাতে লিপিবদ্ধ থাকবে। অন্যথায় স্বজনপ্রীতি করে ঔষধ সংগ্রহ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়াও মেডিসিন, সার্জারি এবং গাইনি বিভাগের প্রত্যেক ওয়ার্ড ইনচার্জকে প্রতি ছয় মাস পর এক্সচেঞ্জ করা হবে। যার ফলে সিস্টাররা সকল বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতিপূর্বে প্রত্যেক ওয়ার্ড ইনচার্জকে বছরে ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ দেওয়া লাগতো তত্ত্বাবধায়ককে। মোট ১০ টি ওয়ার্ড থেকে ২ লক্ষ করে টাকা তোলা হতো। যা দিয়ে এক এক জন ইনচার্জ তাদের ইচ্ছামতো এক এক ওয়ার্ড পরিচালনা করতো। ঔষধ, ইনজেকশন থেকে শুরু করে রোগীদের পালস্ বুঝে সেবা দিতেন ওয়ার্ড ইনচার্জরা। যা নতুন তত্ত্বাবধায়ক এসে স্বচ্ছ করে তুলেছে। বর্তমানে প্যাথলজি বিভাগে নির্ভুল রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের প্যাথলজি এবং ব্লাড ব্যাংক আলাদা করা হয়েছে। যার ফলে ডোপ টেস্টে এখন অনিয়ম করার সুযোগ নেই। নতুন করে অর্থনৈতিক তদারকি কমিটি করা হয়েছে, কেবিন রাজনীতি মুক্ত করা হয়েছে। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দ্বারা দালাল অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অর্থপেডিক্স ওটিতে যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। মেশিনের অভাবে ডেন্টাল ইউনিটে দাঁতের চিকিৎসা বন্ধ ছিল, যা চালু করা হয়েছে। নাক, কান ও গলার অপারেশন যন্ত্রপাতির অভাবে চিকিৎসা বন্ধ ছিল সেটিও চালু করা হয়েছে। সুপীয় পানির জন্য ৭টি আরও ফিলটার বসানো হয়েছে। বাৎসরিক গড়ে রোগী রেফার্ডের পার্সেন্ট ৩ থেকে কমিয়ে এক পাসেন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও কনসালটেন্ট ও নার্সিং সুপারভাইজার এবং ওয়ার্ড মাস্টারদের সান্ধ্য রাউন্ড নিয়মিত করা হয়েছে। রোগীদের খাবারের জন্য নতুন রান্নাঘর পরিবর্তন করা হচ্ছে। সিনিয়র ডাক্তাররা রাতে ডিউটি পালন করছে।
হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স মিথিলা খাতুন জানান, তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান যোগদানের পর থেকে সঠিকভাবে সেবা দিতে পারছি। রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য যে মেডিসিন ও ইনস্ট্রুমেন্ট আগে আসতো তা রোগীদের সঠিকভাবে সাপ্লাই দিতে পারতাম না, এখন তা সম্ভব হয়েছে। সব থেকে দামি অ্যান্টিবায়োটিক যেমন এক গ্রাম মেগাপাইম, এক গ্রাম মেরোপেনাম রোগী প্রতি তিনবার করে দিতে পারছি। রোগীর বেড ছিট, বালিশের কাভার পর্যাপ্ত সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। সেবার কাজে যে কোন ইনস্টুমেন্ট পর্যাপ্ত পরিমাণে পাচ্ছি। আমাদের পরিশ্রমী নার্সরা সেবা দেওয়ার পরিবেশ ফিরে পেয়েছে। ক্ষমতাসীন নার্সদের চেঞ্জ করে দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ে চাহিদা চেয়ে আমাদের নার্সদের শূন্যপদের স্থানে ইতিমধ্যে ৫ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন, আরও ১০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া ফাইনাল করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। যার ফলে আমাদের সেবা দিতে অনেক সহজ হবে।
জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয় সাইফুল ইসলাম জানান, হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ব্যবহৃত সুতা, ভায়োডিন, ক্রিম, টলি, নিডিল, নতুল হুইল চেয়ারসহ যাবতীয় ইকুইপমেন্ট নতুন তত্ত্বাবধায়ক যোগদানের পর পর্যাপ্ত পাচ্ছি। সেবা দিবে আমাদের কোন কিছুর ঘাটতি নেই এখন।
ফার্মেসি বিভাগের ওয়ার্ড বয় সাকিব আহমেদ তন্ময় জানান, আগে সরকারি স্টাফরা সট স্লিপ ব্যবহার করে ঔষধ তুলতে পারতো। যার ফলে অনেক ঔষধ হিসাবের বাইরে চলে যেত কিন্তু এখন হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারী সকলকে নতুন তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসা বহি এর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আগে অনেকে ক্ষমতার ব্যবহার করে বেশি করে ঔষধ নিয়েছে এখন সেগুলো বন্ধ আছে। আমাদের কাছে ঔষধ আসলে আমরা এখন রোগীদের নিয়মমাফিক ঔষধ প্রদান করতে পারছি।
অপারেশন থিয়েটারের ওটি বয় মেহেদী হাসান জানান, ওটির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিপূর্বে রোগীর অপারেশন করার আগে অতিরিক্ত ঔষধ লেখা হতো যা ব্যবহারের পর ফেরত দেওয়া হত না কিন্তু এখন অপারেশন শেষে কোন ঔষধ থেকে গেলে সেটি ফেরত দেওয়া হয়। অপারেশন সংক্রান্ত জীবাণুনাশক ঔষধ যেমন ভায়োডিন, হেক্সিসল, হাইড্রজেনপারআক্সাইড, ইউজলসহ বিভিন্ন সামগ্রী প্রয়োজন বাদে রোগীকে ফেরত দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রত্যেকটা অপারেশন সিরিয়াল অনুযায়ী করা হয়।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে হাসপাতালটি ছিল জর্জরিত। আমি যোগদানের পর থেকে সকলকে নিয়ম মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছি। আগে হাতে রিসিভ লিখে টাকার লেনদেন হতো বর্তমানে কম্পিউটার অপ্টিমাইজ পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সকল ডা. কর্মকর্তা এবং স্টাফরা সঠিক টাইমে আসবে এবং তাদের ডিউটি শেষ করে হাসপাতাল ত্যাগ করবেন। এছাড়াও হাসপাতাল সংক্রান্ত যে কোনো অপরাধের সাথে জড়িত হলে যেই অপরাধী হোক না কেনো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, দালাল সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে সকল অনিয়ম রুখতে ঝিনাইদাহবাসী সহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর