![BD24LIVE.COM](https://www.bd24live.com/bangla/public/logo-bd24live.png)
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার কীভাবে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের নামিয়ে দিয়েছিল, তার বিবরণ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হয়।
এতে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উসকানি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সংগঠিত করা হয়। কাজটি করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন।
এই প্রতিবেদনের ‘আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগ-পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন’ -অংশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগ সভাপতিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করার অভিযোগের বিষয়টি উঠে আসে। এর সঙ্গে পুলিশের আরও বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকায় যাওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে।
এতে বলা হয়, বিক্ষোভ যতই এগিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী তত বেশি করে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের বিক্ষোভ দমনে অন্তর্ভুক্ত করতে থাকে। এর মধ্যে যুবলীগের সদস্যরাও ছিলেন। আওয়ামী লীগের যুব শাখা হিসেবে সংগঠনটি পরিচিত। তবে অনেক মধ্যবয়সী পুরুষও সহিংসতায় জড়িয়েছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৪ জুলাইয়ের পরবর্তী দুই দিন ধরে এই হামলা অব্যাহত ছিল। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ওএইচসিআর জানতে পারে, আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার কাজটিও চালিয়ে যেতে থাকেন। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ছিল নির্বিকার।
এক নেতা ওএইচসিএইচআরকে বলেন, আমাদের (আওয়ামী লীগের) সাধারণ সম্পাদকের আহ্বানে মাঠে নেমে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ঠেকানোর কথা ছিল ছাত্রলীগ কর্মীদের। কিন্তু যা ঘটে তা অপ্রত্যাশিত ছিল, শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
ছাত্রলীগ এককভাবে ক্রমবর্ধমান আন্দোলন দমন করার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি অর্জনে ব্যর্থ হলে পুলিশ আরও বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয়। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পুলিশ কম ক্ষতিকর অস্ত্র যেমন টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করলেও কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী ধাতব গুলিভর্তি বন্দুক ব্যবহার করে।
অভ্যন্তরীণ একটি সূত্রের খবর, যাত্রাবাড়ী থানায় আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা অবস্থান করেছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অধীন পুলিশের রাজনৈতিকীকরণের মাধ্যমে এই কাজ সহজতর হয়েছিল; যা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের মধ্যে গভীর যোগাযোগ তৈরি করেছিল।
১৮ জুলাই থেকে, বিশেষত আগস্টের শুরুর দিকে বিক্ষোভ যখন জোরালো হয়ে ওঠে, তখন আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকেরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আরও বড় পরিসরে নিজেরাই হামলা চালাতে শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক ওএইচসিএইচআরকে জানান, আওয়ামী লীগ আর ছাত্রলীগ সমর্থকদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অনিয়ম হয়েছে। তাদের অনেকেই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অবৈধ উদ্দেশ্যে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছেন।
সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা পুলিশের সহায়তায় হামলা চালায়। এসব হামলায় ১৬ জুলাই অন্তত ছয়জন নিহত হন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেরোবি শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার হত্যার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে আরও বেশি শিক্ষার্থী, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেন।
ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে থেকেই সরকার আরও সামরিক কৌশল ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশকে সহায়তা করতে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়, যারা সামরিক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল।
সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছিলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনে করতেন, যদি আমরা আমাদের ‘হেভি ইউনিট’ মোতায়েন করি, তাহলে কেবল ‘জিহাদিরাই’ রাস্তায় থাকবে, আর অন্যরা বাড়ি ফিরে যাবে।
১০ জুলাই থেকে দেশব্যাপী পুলিশের পাশাপাশি র্যাব মোতায়েন করা হয়। আন্দোলন চলাকালীন, র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন সক্রিয় ছিল। ১৫ জুলাই থেকে আনসার ও ভিডিপির অন্তত ১৪টি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়। ১৬ জুলাই থেকে বিজিবি মোতায়েন করা হয়, যারা ৫৮টি স্থানে প্রায় চার হাজার সদস্য পাঠায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন অভিযানে সহায়তা করতে একই দিনে ছয়টি সশস্ত্র পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়। তারা শটগান ও রাইফেল ব্যবহার করে। ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডি জি এফ আই) প্রায় ১১০ জন কর্মকর্তা ও ৯০০ মাঠকর্মীকে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠায়, অন্যদিকে ১৪০ জন কর্মকর্তা ও এক হাজার কর্মী গোয়েন্দা তথ্য পরিচালনা ও বিতরণের দায়িত্বে ছিলেন।
১৭ জুলাই র্যাব ও বিজিবি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বড় ও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করা হয়। কিন্তু এর ফলে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন সংসদ সদস্যসহ আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা মারণাস্ত্র নিয়ে সাভারের আশুলিয়ায় ৪ আগস্ট শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালান। এতে তিনটি শিশু ও চারজন ব্যক্তি গুলিতে আহত হন।
নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করতে, তাদের নির্দেশনা দিতে, অভিযানের পরিকল্পনা করতে এবং বিক্ষোভ পর্যবেক্ষণ ও দমনের প্রচেষ্টা চালাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘কোর কমিটি’ নামে একটি সংস্থার নিয়মিত বৈঠকে সভাপতিত্ব করতেন, যা তার বাসভবনে অনুষ্ঠিত হতো।
এতে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক, বিজিবি, র্যাব ও আনসার-ভিডিপির প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনাররা উপস্থিত থাকতেন। ২০ জুলাই থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলও থাকতেন।
শেখ হাসিনা ও তার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে সশরীরে ও টেলিফোনে শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং তাদের কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করতেন, যা সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং ওএইচসিএইচআরকে সরবরাহ করা কললিস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর