
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুল হক আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে পাইলট স্কুলসহ গোটা উপজেলায় একক কর্তৃত্ব চালিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার একচ্ছত্র আধিপত্য ও বেপরোয়া দুর্নীতিতে অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ ও অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ছাত্র-জনতা ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে তার অনিয়ম- দুর্নীতির বিচার দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের জবাব সন্তোষ জনক না হওয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন উপজেলা প্রশাসন।
জানা যায়, পীরগঞ্জ পৌর যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বরত অবস্থায় ২০০৯ সালের শেষের দিকে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মফিজুল হক। অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও সে সময় স্কুলের সভাপতি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইমদাদুল হক বিশেষ সুবিধা নিয়ে দলীয় বিবেচনায় তাকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই স্কুলটিকে এক অনিয়ম দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেন মফিজুল হক।
পরবর্তীকালে উপজেলা আ. লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়ে সাবেক এমপি ইমদাদুল হককে হাত করে নানা রকম অনিয়ম, দুর্নীতি করে স্কুলের আয়ের টাকা স্কুলের ফান্ডে জমা না করে সেই টাকা নিজে আত্মসাৎ করেছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তাদের নিকট হতে স্কুলের উন্নয়নের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা গ্রহণ করে সেই টাকা স্কুল ফান্ডে জমা করেননি।
স্কুলের কোন প্রভাতি শাখা নামে একটি শাখা খুলে একেকজন শিক্ষকের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকা করে নিয়ে ১৪/১৫ জনকে চাকরি প্রদান করেন। উক্ত টাকার এক টাকাও তিনি স্কুলের ফান্ডে জমা করেননি। স্কুলে ১০ জন অতিথি শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। প্রত্যেকের নিকট থেকে দুই থেকে তিন লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে। এই টাকার একটিও স্কুলের তহবিলে জমা হয়নি।
অপর দিকে এই অতিথি শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উপর বিভিন্ন ফি চাপিয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি মসজিদ ফি ও বিদ্যুৎ বিলের জন্যও শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে দুইশো টাকা করে নিয়ে তা প্রধান শিক্ষক আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন ও বেতনও বেশি করে নেওয়া হয়। জেএসসি এবং এসএসসির প্রশংসাপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ভাবে নেওয়া হয়। এসবের বেশির ভাগ টাকা স্কুল তহবিলে জমা হয় না।
স্কুলের জায়গা ব্যবহার করে ৫০টিরও অধিক দোকানপাট নির্মাণ করে সেই দোকানের জামানতের কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রধান শিক্ষক। স্কুলের জমিতে থাকা দোকান ঘরগুলির নামকা ওয়াস্তে ভাড়া দেখিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করে আসছেন তিনি। এছাড়াও স্কুলের উত্তর পার্শ্বে থানা প্রাচীর সংলগ্ন অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং ও পুকুরপাড় সংলগ্ন হলরুম নির্মাণে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। যা কোনো প্রকার টেন্ডার/বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ছাড়াই তার পছন্দের লোক দিয়ে নির্মাণ কাজ করে কয়েক লাখ টাকা পকেটস্থ করেছেন।
স্কুলের পশ্চিম পার্শ্বে স্কুলের নামে লিজকৃত রেলের জমিতে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতো। প্রধান শিক্ষক মফিজুল হক কৌশলে সে মাঠ নিজের নামে লিজ নিয়ে সেখান বাণিজ্যিক দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন।
২০১৭ সালে স্কুলের ১২টি ফলজ ও বনজ গাছ এবং ২০২৩ সালে মসজিদ সংলগ্ন ৩টি নিম, কড়ই, মেহগনি গাছ বিক্রি করে সে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন না করে স্কুলটিকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করার পাশাপাশি দলের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (মাধ্যমিক) পীরগঞ্জ উপজেলা সভাপতির পদ দখল করে আছেন এবং সমিতির ১৬ লক্ষ টাকাও তছরুপ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিগত সময়ে পীরগঞ্জ উপজেলায় তাকে চাঁদা না দিয়ে কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। চাঁদা না দিলে শিক্ষক সমিতি ও আওয়ামীলীগের নেতা হিসেবে শিক্ষা অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় অহেতুক ঝামেলা করেছেন তিনি। বাধ্য হয়ে তাকে ম্যানেজ করেই নিয়োগ দিতে হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। তাকে বাদ দিয়ে হাই স্কুলে চাকরি পাওয়া বা নিয়োগ দেওয়া ছিল অসম্ভব।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য করেই তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। আর সেই টাকা দিয়ে তিনি পীরগঞ্জ শহরে একাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ এবং বেশ কয়েক বিঘা কৃষি জমি ক্রয় করেছেন। স্ত্রীর নামে ব্যাংকে নগদ টাকাসহ প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের ডিপিএস জমা করেন।
২০০০ থেকে ২০২৪ সালে পর্যন্ত নকল জাল রেজুলেশন ও সাবেক এমপি ইমদাদুল হক জাল স্বাক্ষর করে একটি ভুয়া কমিটি করেন। এই সময়ে ২ কোটি ৩৭ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৯১ টাকা আত্মসাৎ করেন। যার খরচ দেখানো হয় মসজিদ নির্মাণের ছাঁদ ডাইলয়ের নামে। অথচ বাস্তবে তার কোন মিল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে তিনি স্কুলের রেজুলেশন বইসহ আয়-বেয়ের সকল হিসাব খাতা নিয়ে পলাতক রয়েছেন।
শাটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারুক হোসেন জানান, একই ব্যক্তি শিক্ষক সমিতির জেলা ও উপজেলা কমিটির সভাপতি থাকেন কিভাবে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তিনি।
পীরগঞ্জ উপজেলার জগথা কলবস্তির গরীব ঘরের সন্তান মফিজুল হক ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। অন্যের সহযোগিতায় বিএ পাস করার পর আওয়ামী যুবলীগ করাবস্থায় উপজেলার ভাকুড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা আ.লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক হয়ে দীর্ঘদিন ধরে রাম রাজত্ব চালিয়ে আসার পাশাপাশি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন রুখে দিতে দমন পীড়নও চালিয়েছেন প্রধান শিক্ষক মফিজুল হক।
সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ছাত্র-জনতা ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিচার দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এর জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। মফিজুল হক সেই নোটিশের জবাব দিয়েছেন। জবাব সন্তোষ জনক না হওয়ায় সম্প্রতি সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রমিজ আলম। এত কিছুর পরও রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. আবু সায়েম বলেন, মফিজুল হক একজন আপাদ মস্তক দুর্নীতিবাজ শিক্ষক। তাকে স্বপদে বহাল রেখে দুর্নীতির তদন্ত করা কতটা যৌক্তিক তা ভাবার বিষয়। প্রশাসনের এমন আচরণ কাম্য নয়।
এ বিষয়ে পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুল হক বলেন, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি প্রতি হিংসার শিকার। সাবেক এমপি ইমদাদুল হক অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকায় এ বিষয়ে তার মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আরিফুল্লাহ বলেন, মফিজুল হক মানে আতঙ্ক। তাকে ছাড়া কোন কাজ করা যেত না। আওয়ামী লীগের এবং শিক্ষক সমিতির ডবল সভাপতির দাপট দেখিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি করেছেন। উপজেলা শিক্ষকরা তার কাছে জিম্মি ছিল।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রমিজ আলম বলেন, পাইলট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে সেই প্রধান শিক্ষক তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন স্কুলের। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষাবোর্ডে অবগত করা হয়েছে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর