
পড়া লেখায় টেনেটুনে এসএসসি পাস করেন। এক সময় এলাকার বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে উৎশৃঙ্খল যুবকদের সাথে সময় কাটাতেন আড্ডায়। বাবা ছিলেন লবণ চাষি।
এক চালা ঘরে পরিবারের লোকজন নিয়ে থাকতেন ঠাসাঠাসি করে। এক সময়ের রিক্তহস্ত সেই যুবক গোসল করেন মাম পানি দিয়ে। চলাফেরা করেন ধনকুবের মত।
আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে ঘুরে বেড়ান মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে। আর সেইসব দেশে যাতায়াত করেন বিমানের বিজনেস ক্লাসে।
এতক্ষণ যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন, কক্সবাজারের বড় মহেশখালীর বড় ডেইল এলাকার কৃষক নাছির উদ্দেনের ছেলে জসিম উদ্দিন নাহিদ। বর্তমানে কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা এলাকায় বসবাস করছেন। রামুর কচ্ছপিয়া থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার পিস জব্দ করা ইয়াবার চালানটির মূল মালিকও তিনি।
কিন্তু এই জসিমের ইয়াবা কাণ্ডের বলি হয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে জড়িয়ে প্রত্যাহার হওয়ায় দেশজুড়ে চলছে অন্তহীন আলোচনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পরের দিন কক্সবাজারে নিয়োগ পান পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ। যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি গণমাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন।
এদিকে ইয়াবা জব্দের পর পুলিশের মামলায় জসিম উদ্দিনকে ২ নম্বর ও তার পার্টনার মো. রনিকে ৩ নাম নম্বর থাকলেও মামলায় তাদের বিস্তারিত ভূমিকা উল্লেখ করেনি।
তবে অনুসন্ধান ও পুলিশ সূত্র বলছে, ইয়াবার চালানের মামলায় তার ঠিকানা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ডিবির একাধিক সূত্র বলছে, এই ঘটনার পর জসিমের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে একটি প্রভাবশালী মহল, যেখানে ডিবির সদস্যরাও রয়েছেন। ইতোমধ্যেই ইয়াবাকাণ্ডের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জসিম উদ্দিন নাহিদকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী থেকে কক্সবাজারে এসে রিগ্যাল প্যালেস হোটেলে কাজ নেন জসিম উদ্দিন নাহিদ। এরপর নিশান গেস্ট হাউসে কাজ করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এরপর জড়িয়ে পড়েন মাদক কারবারে। এভাবে উত্থান হওয়া জসিম টেকনাফ ও ঢাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করে গড়ে তোলেন শক্তিশালী এক মাদক সিন্ডিকেট।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ঢাকা ও দুবাইতে কোটি কোটি টাকার সম্পদও গড়েছেন। দুবাইয়ের আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী আরাভ খানের সঙ্গে তার ব্যবসা রয়েছে। আরাভ খানের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় নাহিদকে দেখা গেছে। অভিযোগ আছে, জসিম উদ্দিন নাহিদ দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ের স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শহেশখালীর সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শরীফ বাদশার মালিকাধীন নিশান গেস্ট হাউসে কাজ করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। হোটেলে কাজ করে চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও ১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে তার ঢাকা ও টেকনাফের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেন এক মাদক পাচারকারী সিন্ডিকেট। বিয়ে করেন কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোশাররফ হোসেন দুলালের মেয়েকে।
মাদক কারবার নির্বিঘ্ন করতে শ্যালক শেফায়েত হোসেন জয়, স্ত্রী-শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘পারিবারিক ইয়াবা সিন্ডিকেট’। ইয়াবা বিক্রি করে খুব অল্প সময়ে ধনী হয়ে ওঠেন। শুধু তা-ই নয়, অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের বড় একটি অংশ পাচার করেন বিদেশে। ৫/৬ জনের এই সিন্ডিকেটে অন্যতম ছিলেন পুলিশ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া আলোচিত আরাভ খান। প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন জসিম উদ্দিন নাহিদ।
সূত্র বলছে, বর্তমানে জসিম সিন্ডিকেটের নেতৃত্বেই মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান দেশে ঢুকছে। টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায় ১০-১৫ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট চালায় এই পরিবার। সিন্ডিকেটের হোতা হিসেবে কাজ করেন তার শ্যালক। স্ত্রী-শ্বাশুড়ি রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে। মাদক কারবার থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকায় তারা ঢাকা শহরে তুলেছেন অট্টালিকা।
কক্সবাজারের স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, জসিম উদ্দিন নাহিদের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা নেই। কিন্তু কয়েক বছরে তিনি রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকায় দুটি ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন। চলেন দামি গাড়িতে। শ্যালক জয়ও তার সঙ্গে থাকেন। কাতার বিশ্বকাপ দেখে দেশে ফেরার পথে প্রবাসে থাকা পরিবারের সদস্যদের ৬০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে ফিরছিলেন চারজন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন কথিত বন্ধু জসিম উদ্দিন নাহিদ। ফেরার পর বিশ্রামের অজুহাতে জসিমের রাজধানীর বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে নিয়ে যান তাদের। স্বর্ণসহ মালামাল রেখে নাশতা করার কথা বলে চারজনকে নিচে নামান জসিম। এই সুযোগে আগে থেকে বাসায় অবস্থান করা তার শ্যালক জয় ৬০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে সটকে পড়েন।
এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান এক ভিডিওতে বলেছেন, জয় ও জসিম কক্সবাজারের মাফিয়া। জয় কিলার, আর জসিম আগামী নির্বাচনে এমপি (সংসদ সদস্য) প্রার্থী। তারা প্রতি মাসেই দুবাই যাওয়া-আসা করেন বলেও জানা গেছে।
উল্লেখ্য, গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে মিলেমিশে সাড়ে ৩ লাখ পিস বিক্রি-এসপির ইয়াবা কারবার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে ১০ কোটি টাকার ইয়াবা ২ কোটি ৯ লাখ টাকায় বিক্রি করে ভাগাভাগি, সোর্স নামধারী চাকরিচ্যুত দুই কনস্টেবলকে ঘুষের ভাগ হিসেবে ১ লাখ ৩০ হাজার ইয়াবা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৬ জানুয়ারি ভোরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চকরিয়ার ডুলাহাজারা এলাকা থেকে ৪ লাখ ৯০ হাজার ইয়াবাসহ টয়োটা কোম্পানির ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো গাড়ি জব্দ করা হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা চারজনকে আটক করে ওসি ডিবি জাহাঙ্গীর আলম, এসআই সমীর গুহর নেতৃত্বাধীন একটি দল। এ সময় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে আটক তিন ইয়াবা কারবারিকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় এসআই সমীর গুহ বাদী হয়ে গাড়িচালক ইসমাইলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে চকরিয়া থানায় ১ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা জব্দের মামলা করেন। উদ্ধার ইয়াবা থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজারটি আত্মসাৎ করা হয়। এ বিষয়ে যোগাযোগ চেষ্টা করা হলেও জসিম উদ্দিন নাহিদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পরদিন কক্সবাজারে যোগ দেন পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ। কিন্তু শপথ নেওয়ার পর থেকেই তিনি ছিলেন গণমাধ্যমের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আর এই সময়েই ঘটে ইয়াবা কাণ্ড, যা দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার গুরুতর অভিযোগ দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।
প্রশ্ন উঠছে—এই কেলেঙ্কারির আসল হোতারা কি ধরা পড়বে?
এই কেলেঙ্কারি শুধু পুলিশ প্রশাসনের জন্য নয়, পুরো আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার জন্যই এক ভয়াবহ কলঙ্ক। প্রশ্ন উঠছে, এসপি রহমত উল্লাহর মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যদি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন, তবে সাধারণ মানুষ কার কাছে বিচার চাইবে?
এ ঘটনার তদন্তের দাবি উঠেছে সর্বস্তরে। কিন্তু আদৌ কি মূল অপরাধীরা ধরা পড়বে, নাকি কেবল কিছু নিম্নস্তরের কর্মচারী বলির পাঁঠা হবে? উত্তর সময়ই বলে দেবে!
যদিও এদিকে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, কক্সবাজারে মাদক জব্দ করে বিক্রির ঘটনায় যদি কারও সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়, তাকে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।
তিনি জানান, ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং এর অংশ হিসেবেই এসপি রহমত উল্লাহকে স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর