
চট্টগ্রাম ওয়াসায় লোকবল নিয়োগে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম ফজলুল্লাহ’র স্বজনপ্রীতি এবং ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকার স্যুয়ারেজ প্রকল্পে অনিয়ম পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক কর্তারা বলছেন, প্রকল্পটির ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ফাটল দেখতে পেয়েছেন তারা। এছাড়া প্রকল্পে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, ওয়াসা ভবনে পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে নথি গায়েব, সাবেক এমডির ভাগ্নেবউকেও প্রকল্পে যুক্ত করাসহ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দিয়ে প্রকল্প পরিচালক করারও অভিযোগ আছে।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে চট্টগ্রাম ওয়াসা কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুদকের চার সদস্যের একটি টিম। এতে নেতৃত্ব দেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম–১ এর সহকারী পরিচালক সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান।
অভিযান শেষে সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান জানান, এ কে এম ফজলুল্লাহ’র আমলে চট্টগ্রাম ওয়াসায় কিছু অনিয়মের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ আছে। এছাড়া ফজলুল্লাহ’র দায়িত্ব পালনের সময় ‘রহস্যজনক’ আগুনে ওয়াসার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পোড়ানো বা গায়েব করার অভিযোগও আছে।
সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ ছিল, হালিশহরে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চলমান স্যুয়ারেজ প্রকল্পের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেখানে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারে অনিয়ম অর্থাৎ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে— এ ধরনের অভিযোগ ছিল। আমরা সরেজমিনে সকালে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে অনেকগুলো ফাটল দেখতে পেয়েছি।
এই ফাটল দেখার পরে এখানে এসেছি এবং প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলেছি। প্ল্যান্টে ফাটলের বিষয়টি তিনি অবগত আছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা জানতে চেয়েছি। উনি বললেন, প্রকল্পের কনসাল্টেড ফার্মের সাথে কথা বলেছেন এবং ফাটল সিল করার জন্য যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হবে সেগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে এখনো রিপোর্ট পাননি। রিপোর্টে রাসায়নিক যথাযথ পাওয়া গেলে ফাটলগুলো সিল করা হবে।’
নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা— প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। এটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞরা বলতে পারবেন। তবে ফাটল দেখা গিয়েছে। এটি নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের ফলে অথবা পারিপার্শ্বিক কারণেও হতে পারে।
পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে সাবেক এমডির বিরুদ্ধে ফাইল গায়েবের অভিযোগ আছে উল্লেখ করে বলেন, ‘সাবেক এমডি দীর্ঘ ১৫ বছর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ আমাদের কাছে আছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে ওয়াসা ভবনের তৃতীয় তলায় একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি সাজানো ছিল— এমন অভিযোগ এসেছে। যেখানে অনেকগুলো নথি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গায়েব করা হয়েছে বলা হয়েছে। আমরা জানতে চেয়েছি এ বিষয়ে। ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির একটি তদন্ত প্রতিবেদন আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। এটি আমরা বিস্তারিত স্টাডি করে বলতে পারবো।’
সাবেক এমডি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এখানে লোকবল নিয়োগ দিয়েছেন— এমন অভিযোগের কথা জানিয়ে দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ওনার (একেএম ফজলুল্লাহ) শেষ ৬ মাসে যে নিয়োগ বা বদলিগুলো হয়েছে— এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চেয়েছি। সচিব মহোদয় এগুলো দেওয়ার কথা বলেছেন। সেই রেকর্ডপত্র পেলে আমরা যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম হয়েছে কি-না জানতে পারবো।’
ওয়াসার এক কর্মকর্তাই স্বজনপ্রীতির তথ্য দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানকার ইঞ্জিনিয়ার মাকসুদ সাহেবের কাছে একটা তথ্য পেয়েছি। সেটা হচ্ছে, একটা স্যুয়ারেজ প্রকল্প ছিল। সেই প্রকল্পে সাবেক এমডি সাহেবের ভাগিনা সরোয়ার জাহানের স্ত্রীকে যুক্ত করা হয়েছে।
এই প্রজেক্টের যিনি পরিচালক এবং নির্বাহী প্রকৌশলী আছেন, অভিযোগ ছিল জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে যারা জুনিয়র ছিল তাদেরকে পদোন্নতি দিয়ে পরিচালক করা হয়েছে। আমরা সচিব মহোদয়ের কাছে জেষ্ঠ্যতার তালিকা চেয়েছি। এটা বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে আমরা বলতে পারব জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে কি-না।’
অভিযানে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পেয়েছেন কিনা— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সাঈদ মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘কিছুটা তো অনিয়ম অবশ্যই আছে। এই যেমন আমরা নিয়োগ সংক্রান্ত একটি তথ্য পেলাম ওনাদের একজন কর্মকর্তার কাছে।
আরও কয়েকজন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এটা আসলে রেকর্ডপত্র যাচাই করে বলতে পারবো। অনিয়ম হলে আমরা যথাযথ নিয়মে ব্যবস্থা নেব।’
এ কে এম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। অবসর নেন ২০০০ সালে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ৬ জুলাই প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর আরও একবছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১১ সালে ঢাকা ওয়াসার আদলে চট্টগ্রাম ওয়াসাতেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ তৈরি করা হয়। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান ফজলুল্লাহ। সেই থেকে এমডি পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাকে অপসারণের আন্দোলন শুরু হয়। ৩০ অক্টোবর তাকে অপসারণ করে সরকার।
ফজলুল্লাহ’র মেয়াদে চট্টগ্রাম ওয়াসা যেসব বড় প্রকল্প নিয়েছে, সেগুলো হলো, কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (সিডব্লিউএসআইএসপি) ও ভান্ডালজুরি পানি সরবরাহ প্রকল্প এবং পয়ঃনিষ্কাশন সংক্রান্ত আরও ছয়টি প্রকল্প।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর