
মরণব্যাধি ক্যানসারের থাবা এখন দেশজুড়ে। এই থাবায় এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চল। প্রতিবছর নতুন নতুন রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এ বর্ধিত রোগীর তুলনায় চিকিৎসা সেবার মান ও সুযোগ-সুবিধা সেভাবে বাড়েনি। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাব প্রকট।
ক্যান্সার নির্ণয়ের আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন প্যাট-সিটি (পজিট্রন ইমিশন টোমোগ্রাফি) ল্যাব চট্টগ্রামে নেই। ফলে ঢাকায় দৌড়ঝাঁপ দিতে হচ্ছে রোগীদের। এছাড়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল পরীক্ষাটি করার ঢাকার বাইরে ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করতে গেলে একটি পরীক্ষায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য কোনো মলিকিউলার ল্যাবও নেই চট্টগ্রামে। ফলে রোগীদের কোন ধরনের ক্যান্সার রোগ হয়েছে এটি শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীদের ঢাকা কিংবা দেশের বাইরের নমুনা পাঠাতে হয়।
ভুক্তভোগীরা জানায়, জটিল রোগের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করতে করতেই রোগীর অবস্থাও গুরুতর হয়ে পড়ে। এতে যেমন ভোগান্তি বাড়ে, অন্যদিকে কয়েক গুণ বাড়ে খরচ। তবে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশেষায়িত ক্যানসার ইউনিটের কাজ চলছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামে সরকারি পর্যায়ে ক্যান্সার চিকিৎসার একমাত্র প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগ। এই বিভাগের সক্ষমতা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও, ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল। চমেক হাসপাতালে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৩০ জন রোগী রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন, কেমোথেরাপি নিচ্ছেন গড়ে ৩৫ জন এবং প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫ জন নারী জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্রেকিথেরাপি নিতে পারছেন।
চমেক হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ড ও বহির্বিভাগ মিলে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ১৯ হাজার ৫৯৪ রোগী। এর মধ্যে নতুন আক্রান্ত রোগী ছিল ৫ হাজার ৬৫৮ জন। নতুন আক্রান্ত রোগীর মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ১৩৮ জন এবং মহিলা ছিল ২ হাজার ৫২০ জন। এছাড়া রেডিওথেরাপি নিয়েছেন ১ হাজার ৫১ জন। জরায়ু ক্যান্সারের ব্র্যাকিথেরাপি নিয়েছেন ২৩৮ জন। সিটি স্টিমুলেটর ১৬৫ জন এবং কেমোথেরাপি নিয়েছেন ২ হাজার ৩৩৩ জন। অপরদিকে গত বছর বহির্বিভাগে স্তন ক্যান্সারের রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন ৬১৪ জন। জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৪১ জন। হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৯৭ জন। কোলারেক্টাল ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ২০৯ জন। ফুসফুসের ক্যান্সারের চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯৮ জন এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ৬৬১ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
গত বছরের রোগীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরুষ রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশ রোগী মুখগহ্বরের, ১৭ শতাংশ ফুসফুস সংক্রান্ত, ১১ শতাংশ খাদ্যনালি, ৫ শতাংশ কোলেরেক্টাল, ৪ শতাংশ পাকস্থলী ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়া বাকি ৪৪ শতাংশ পুরুষ অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন। নারীদের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ নারী স্তন ক্যান্সারে, ১৮ শতাংশ নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে, ১৩ শতাংশ নারী মুখগহ্বর ক্যান্সারে, ৬ শতাংশ নারী খাদ্যনালি ক্যান্সারে, ৫ শতাংশ ফুসফুসের এবং ৩৬ শতাংশ নারী অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের অধীনে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার হার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে বেশি ৪০ থেকে ৬০ বছর এবং ৫০ থেকে ৬০ বছর সময়ের মধ্যে। এই দুই বয়সসীমায় আক্রান্তের হার ২১ শতাংশ। চমেক হাসপাতালে তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। হাসপাতালে একটি কোবাল্ট রেডিওথেরাপি যন্ত্র রয়েছে। এটি দিয়ে দৈনিক ৮০ থেকে ১০০ জন রোগীকে টু ডাইমেনশনাল এক্সটার্নাল বিম রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া যায়। এ জন্য খরচ হয় প্রায় ৮ হাজার টাকা।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার আক্রান্তদের ব্র্যাকিথেরাপি নিতে হয়। প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালে ব্র্যাকিথেরাপি যন্ত্র বসানো হয় হাসপাতালে। গত বছরের জুন মাসে সেটি নষ্ট হয়ে যায়। সরকারিভাবে খরচ দেড়-দুই হাজার টাকা হলেও ঢাকায় বেসরকারিভাবে ব্র্যাকিথেরাপি নিতে প্রতি সেশনে খরচ হয় ৫ হাজার টাকার বেশি। চমেক হাসপাতালে ক্যান্সার শনাক্তে নেই প্যাট-সিটি স্ক্যানের ব্যবস্থা। ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। রোগ শনাক্তে নেই মলিকুলার ল্যাবও।
অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, মলিকুলার ল্যাবের মাধ্যমে যে ফল পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই নির্দিষ্ট থেরাপি দিতে হয় রোগীকে। ভরসার এই বিভাগের অবস্থাও খুব নাজুক। এখানে পুরুষ ও নারীদের জন্য শয্যা রয়েছে ১৫টি করে মাত্র ৩০টি। ডে কেয়ার বেড আছে মাত্র ৯টি। সংকট রয়েছে চিকিৎসক-নার্সের।
চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর স্বজন বলেন, সরকারি হলেও চমেক হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে দেরি হয়। রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতি না থাকায় ঢাকা ও দেশের বাইরে ছুটতে হয়। এতে খরচ ও দুর্ভোগ উভয় বাড়ছে।
জানা যায়, চমেক হাসপাতাল এলাকায় ৩০ কাঠা জায়গায় ২ হাজার ৩৮৮ কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা ব্যয়ে আলাদা ক্যান্সার ইউনিট স্থাপন করা হচ্ছে। ১৫ তলা বিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় থেকে সপ্তম তলা জুড়ে থাকছে ১৮০ শয্যাবিশিষ্ট ক্যান্সার ইউনিট। যেখানে সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি অনকোলজি, রেডিওথেরাপি, ব্র্যাকিথেরাপি এবং অনকো-সার্জারিও থাকবে। প্যাট-সিটি স্ক্যান যন্ত্র স্থাপিত হলে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় রোগীরা পরীক্ষা করতে পারবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে ক্যান্সার ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন করছে ‘ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেস (ইনমাস) সাইক্লোট্রন ও প্যাট-সিটি সুবিধাদি স্থাপন’ প্রকল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্যান্সার শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার সক্ষমতা অনেক বাড়বে। সাইক্লোট্রন যন্ত্র কৃত্রিম রেডিওআইসোটোপ তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা প্যাট-সিটি স্ক্যানের জন্য বিশেষ করে থাইরয়েড, যকৃত, কিডনি এবং হাড়ের ক্যান্সার নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়। এই যন্ত্রপাতি দেশে স্থানীয়ভাবে রেডিওআইসোটোপ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। এতে ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ এবং প্রতীক্ষার সময় কমাবে।
চমেক হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল অনকোলজি ও রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আমাদের চিকিৎসা সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। একসময় ক্যান্সারের চিকিৎসায় রোগীদের ঢাকার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হতো। এখন সেটি হচ্ছে না। এতে রোগীদের সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। আমাদের ওয়ার্ডে রোগীরা রাত ১২টা পর্যন্ত রেডিওথেরাপি নিতে পারছেন। এছাড়া কেমোথেরাপির সক্ষমতাও বেড়েছে। অন্যদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে একমাত্র আমাদেরই ব্রেকিথেরাপি মেশিন আছে। এতে করে জরায়ু চিকিৎসায় আক্রান্ত রোগীরা ভালো সেবা পাচ্ছেন। এছাড়া চমেক হাসপাতালে নির্মাণাধীন ১৮০ শয্যার বিশেষায়িত ক্যান্সার ইউনিটের কাজ শেষ হলে নতুন নতুন অনেক সরঞ্জাম যুক্ত হবে। একইসাথে রোগীদের আরো অত্যাধুনিক উপায়ে চিকিৎসা দিতে পারব।
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এম মঞ্জুর আহসান বলেন, সাইক্লোট্রন ও প্যাট-সিটি সুবিধার এই প্রকল্পটি দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি শুধু ক্যান্সার রোগীদের সময়মতো সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নয় বরং দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর