
অন্যায়-অবিচার ছড়িয়ে পড়লে ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই মানবতার অপরিহার্য আশ্রয়স্থল হয়ে পড়ে। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তিনি ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এমন এক সমাজে আগমন করেছিলেন, যেখানে সাম্য ও ন্যায়বিচারের কোনো স্থান ছিল না।
শক্তিশালী দুর্বলকে চূর্ণ করে দিত, ধনীরা দরিদ্রদের ওপর নির্যাতন চালাত, কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, গোত্রীয় অহংকারের কারণে রক্তের হোলি খেলা চলত। সেই বর্বর যুগে তিনি আলোর মশাল হাতে সমাজকে আলোকিত করেছেন, স্থাপন করেছেন ন্যায়, সুবিচার ও ইনসাফভিত্তিক মহান আদর্শ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে ইনসাফের ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত
একবার মাখজুম গোত্রের এক মহিলা মক্কা বিজরের সময় চুরি করেছিল। বিষয়টি নিয়ে কুরাইশরা উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। তখন তারা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলো—
রাসুল (সা.)-এর কাছের কোনো সাহাবার মাধ্যমে সুপারিশ করবেন। হয়তো সুপারিশের ফলে রাসুল (সা.) চুরির শাস্তি দেবেন না। সুপারিশের জন্য তারা রাসুলের প্রিয় সাহাবি উসামা (রা.) কে নির্ধারণ করলো। উসমা (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে সুপারিশ করলেন। সব শুনে রাসুল (সা.) রাগত স্বরে বললেন—
আল্লাহর শপথ, আামর মেয়ে ফাতিমা (রা.) যদি চুরি করে আমি তার হাতও কেটে ফেলব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৮)
এই ঘোষণা শুধু একক কোনো বিচারের জন্য ছিল না, বরং এটি সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্পের প্রকাশ।
মনিব ও ক্রীতদাসের মাঝে সমান ন্যায়বিচার
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ছিল না। একবার এক ক্রীতদাসের মালিক তাকে বকাঝকা করছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন—
এই ক্রীতদাসও তোমার মতো একজন মানুষ। আল্লাহ তোমার ওপর যেমন কর্তৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি তার ওপরও রয়েছে অধিকার। তুমি যা খাও, তাকে তা খেতে দাও, যা পরো, তা পরতে দাও। কারণ, সে তোমার অধীনস্থ হলেও আল্লাহর দৃষ্টিতে সে তোমার সমান। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৪৪)
অমুসলিমদের প্রতি ন্যায়বিচার
ইনসাফ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য সমান। একবার এক ইহুদি ও এক মুসলমানের মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। ইহুদির অভিযোগ ছিল, মুসলমান ব্যক্তি তার সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচাই-বাছাই করে দেখলেন, ইহুদির দাবি সঠিক। ফলে তিনি মুসলমানের বিপক্ষে রায় দিলেন। এ ঘটনায় মুসলমান ব্যক্তি রাগান্বিত হলে কোরআনের আয়াত নাজিল হলো—
কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের ইনসাফহীন না করে তোলে। ইনসাফ করো, এটি তাকওয়ার কাছাকাছি। (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৮)
রাষ্ট্র পরিচালনায় ইনসাফ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি প্রথমেই ইনসাফভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু করলেন। তিনি মদীনার মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে মদীনা সনদ প্রণয়ন করেন। এটি ছিল ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান, যেখানে ইনসাফকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়।
ইনসাফ শুধু আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় না, এটি গড়ে তুলতে হয় হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রপরিচালনা, সর্বত্র ইনসাফের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি আজকের সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর