
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা মূলত পুলিশের ওপর দায় চাপিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই তিনটি নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন ও রাতের ভোটের নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা সবচেয়ে বেশি। এই দুটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত জেলা প্রশাসকদের মধ্যে বর্তমানে যারা অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত আছেন, তাদের মধ্যে ২২ জন অতিরিক্ত সচিবকে সরকারী চাকরির ২৫ বছর পূর্তিতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, এবং ৪৫ জন যুগ্ম সচিবকে ২৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় ওএসডি করা হয়েছে।
২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসকদের বিষয়ে সরকারী পর্যায়ে অনুসন্ধান চলছে। এই অনুসন্ধান মূলত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনিয়ম এবং দায়িত্ব পালনের সঠিকতা নির্ধারণের জন্য পরিচালিত হচ্ছে।
নির্বাচনের দায়িত্ব ও প্রশাসনের ভূমিকা
একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা কী ভূমিকা পালন করেন, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি জেলায় সংসদ নির্বাচনের সর্বময় কর্তৃত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তার হাতে থাকে, এবং বিগত বিতর্কিত নির্বাচনগুলোতে জেলা প্রশাসকগণ এই দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারগণ নির্বাচনের দিন সরাসরি দায়িত্ব পালন করেন এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাদের সহযোগিতায় প্রতি কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকেন ১২ জন আনসার সদস্য, যারা নির্বাচন কেন্দ্রের ভেতরে অবস্থান করে।
পুলিশের ভূমিকা কতটুকু?
নির্বাচন কেন্দ্রের বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল পুলিশের ওপর, তবে তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাব সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) অধীনে এই বাহিনী কাজ করে।
যদিও বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর পর মূলত জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর ওপর। এতে প্রশ্ন উঠছে, শুধুমাত্র পুলিশ সুপারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে আনসার, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ভূমিকা কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে?
নির্বাচন বিতর্ক ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যেই দোষারোপের সংস্কৃতি চলছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোটের নির্বাচন’ হিসেবে সমালোচিত, যেখানে ভোটগ্রহণের আগের রাতেই ব্যালট ভর্তি করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘ডামি নির্বাচন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে, যেখানে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অধিকাংশই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
এই তিনটি নির্বাচনে ৮টি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের অধীনে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) ছিলেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি, ভোট জালিয়াতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারীভাবে পর্যালোচনা চলছে।
প্রশাসনের ভেতরের স্বীকারোক্তি
বদিউল আলম মজুমদারসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে তারা ডিসিদের নির্দেশে অনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনেরও তথ্য পাওয়া গেছে।
এই প্রসঙ্গে সংস্কার কমিশনের একটি সভায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনিয়ম নিয়ে আলোচনা করা হয়। এতে বর্তমান প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। তবে প্রশাসনের ভেতর থেকে একটি বড় অংশ নিজেদের দায় এড়াতে পুলিশ বাহিনীর ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভবিষ্যতে নির্বাচনী সংকটের আশঙ্কা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতগুলো সংস্থার সদস্যদের শাস্তির আওতায় আনলে ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে কোন আনসার, পুলিশ, বিজিবি বা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হবেন না। ফলে নির্বাচন ব্যবস্থায় শূন্যতা সৃষ্টি হবে এবং এটি কার জন্য লাভজনক হবে, সে প্রশ্নও থেকে যায়।
সর্বশেষ খবর
অন্যান্য... এর সর্বশেষ খবর