
আলীমামুদপুর গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল মন্ডল এবার ৮ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। ৩ বিঘা জমির আলু তুলেছেন। বাকিটা মাঠেই পড়ে আছে। তার বাড়ির পাশেই গোপীনাথপুর হিমাগারে আলু বুকিং দিতে এসে শোনেন বুকিং নেওয়া শেষ।
এদিকে, বাজারে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে আলু। এতে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে তাঁর। তবে অল্প পরিমাণ খাবার ও বীজ আলু রাখতে পারলেও কিছুটা উপকৃত হতেন বলে জানান তিনি। প্রতি বছর ব্যাপক আলু উৎপাদন হয় জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে।
চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৬’শ ৮০ হেক্টর বেশি জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছে। এবার আলু উত্তোলন শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মাঠেই কৃষকের উৎপাদিত অর্ধেক আলু রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগ।
এদিকে উৎপাদনের অর্ধেক আলু মাঠে রেখেই সংরক্ষণের বুকিং নেওয়া সমাপ্ত ঘোষণা করেছে হিমাগারগুলো। আলুর বুকিং কার্যক্রম শেষ হওয়ায় খাবার ও বীজ আলু সংরক্ষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আলু চাষীরা। তারপরও প্রতিদিন আলুর বুকিং নিতে হিমাগারগুলোতে ভিড় করতে দেখা গেছে চাষীদের। বুকিং না পেয়ে এক বুক হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এই উপজেলায় ৫ হাজার ৯’শ ২০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল। এই বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৬’শ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৬’শ ৮০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ বেশি হয়েছে। এবারে মোট উৎপাদিত আলুর পরিমাণ প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে কৃষি বিভাগের ধারণা। এখন পর্যন্ত কৃষকের প্রায় ২ হাজার ৬’শ হেক্টর জমির আলু মাঠেই অনুত্তোলিত অবস্থায় আছে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই উপজেলায় আলু সংরক্ষণের জন্য দুটি হিমাগার রয়েছে। একটি গোপীনাথপুর হিমাগার লিমিটেড অপরটি তিলকপুর ইউনিয়নের দীনা কোল্ড ষ্টোরেজ লিমিটেড।
হিমাগারগুলো ইতোমধ্যেই তাদের আলু বুকিং কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করছে। আলু বুকিং দিতে না পেরে ফিরে যেতে হচ্ছে কৃষকদের। এতে উৎপাদিত আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় ও বিপাকে পড়েছেন তারা।
জানা গেছে, দুটি হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা ১ লক্ষ ২০ হাজার বস্তা। মেট্রিক টন হিসেবে এ দুটি হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা ১৪ হাজার মেট্রিক টন। যা মোট উৎপাদনের সাড়ে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে গোপীনাথপুর হিমাগারে পার্শ্ববর্তী ক্ষেতলাল এবং বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা আগে ভাগেই হিমাগারে এসে নগদ টাকা দিয়ে আলু বুকিং করেছেন। এতে অনেকাংশেই বঞ্চিত হয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। এদিকে উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের দীনা কোল্ড স্টোরেও একই চিত্র দেখা গেছে।
সেখানে পার্শ্ববর্তী নওগাঁ সদর উপজেলা ও বগুড়ার শান্তাহারের কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা অনেক আগেই বুকিং কার্যক্রম শেষ করে ফেলেছেন। ফলে এই উপজেলার মাঠে রয়ে যাওয়া আলু চাষীরা সময় মতো বুকিং দিতে না পারায় আলু সংরক্ষণ নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।
স্থানীয় বাজার গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকারভেদে পাইকারি দামে কার্ডিনাল আলু ৫’শ ৫০ থেকে ৫’শ ৭০ টাকায়, ডায়মন্ড আলু ৫’শ থেকে ৫’শ ২০ টাকায়, স্টিক আলু ৪’শ ৭০ থেকে ৪’শ ৮০ টাকায় ও দেশি আলু ৭’শ টাকা পর্যন্ত বাজারে বিক্রয় করছেন কৃষকরা।
আবার সেই আলু প্রতিমনে উৎপাদনে খরচ পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা। হিমাগারে খাবার আলু ও বীজ আলু সংরক্ষণ করতে না পারলে আরও লোকসান গুনতে হবে এমনটি দাবি করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
গোপীনাথপুর হিমাগারের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে মামুদপুর গ্রামের কৃষক মাহবুব আলম অভিযোগ করে বলেন, আমরা অল্প করে আলু রাখবো, সেই সুযোগও পাচ্ছি না। অনেকেই এসে ঘুরে যাচ্ছেন, আবার অনেকেই বুকিং নেই বলার পরেও বুকিং পাচ্ছেন। এবার আলু ব্যবসায়ীরা সব বুকিং নিয়ে নিয়েছে। আমরা স্থানীয়রা অল্প করে হলেও কী বুকিং পাব না ?
উপজেলার কানুপুর গ্রামের আলু ব্যবসায়ী শফিউল ইসলাম বলেন, আমি গত কয়েক বছর থেকে আলুর ব্যবসা করছি। গত বছর আলুতে অনেক লাভ হয়েছে। তাই এ বছর আমার নামে গোপীনাথপুর হিমাগারে ১ হাজার ৫’শ বস্তা আলুর বুকিং দিয়েছি। আমার নামে বুকিং হলেও আমার সাথে কয়েকজন আলু ব্যবসায়ী শেয়ার আছে। সবাই মিলে বুকিং করা ১ হাজার ৫শ বস্তা আলু রাখবো।
গোপীনাথপুর হিমাগার লিমিটেডের ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী এবারের বুকিং কার্যক্রম শেষ করেছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও যারা আগে এসেছিল প্রত্যেকেরই বুকিং নেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয়দের জন্য ১০ হাজার বস্তার বুকিং কার্ড হাতে রাখা হয়েছে। তাদের ভোটার আইডি কার্ড দেখে বুকিং কার্ড দেয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, হিমাগার ফুল করতে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রিম বুকিং কার্ড দেওয়ার একটা নিয়ম আছে। এ ক্ষেত্রে কৃষকরা অগ্রিম কার্ড নিতে চায় না। এই সুযোগ মূলত ব্যবসায়ীরাই কাজে লাগায়। গত বছরও আলুর অভাবে অনেক হিমাগার ফাঁকা ছিল, এবারই চিত্র উলটো।
তিলকপুর দীনা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক সুপন বড়ুয়া বলেন, বিভিন্ন কারণে এই বছর শুরু থেকে কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে আলুর বুকিং নিয়েছি। বর্তমানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বুকিং নিচ্ছি। বাজারে আলুর দাম কম থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর আলু সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের চাহিদা প্রায় ৪গুন বেশি। তবে আমরা হিমাগারের নিকটবর্তী এলাকার কৃষকদের প্রাধান্য দিয়ে বুকিং নিয়েছি।
বাহিরের ব্যবসায়ীরা এবার অগ্রিম আলুর বুকিং কার্ড নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, হিমাগারের সংরক্ষণে ব্যবসায়ীরাই প্রাণ। তারা আলু সংরক্ষণ না করলে শুধু কৃষকদের আলুতে হিমাগার ভরবে না। তবে বাহিরের নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অল্প করে অগ্রিম কার্ড নিয়েছেন। গত কয়েক বছর আলু রেখে লাভ হওয়ায় এবার কৃষকরা সংরক্ষণে ঝুঁকে পড়েছেন। তার ওপর বাজারে আলুর দাম কম এবং উৎপাদন বাম্পার হয়েছে।
আলু ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান বলেন, হিমাগার যখন ফাঁকা থাকে, তখন মালিকরা ব্যবসায়ীদের অনেক অনুরোধ করে আলু রাখতে। এবারের চিত্র একেবারেই আলাদা। বাজারে আলুর দাম কম হওয়ায় মূলত কৃষকরা এবার আলু হিমাগারে সংরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
তাদের পিড়াপিড়িতে এবার অনেক ব্যবসায়ীই আলু সংরক্ষণ করবেনা। আর কৃষকরা রাখলেও ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি নেই। তাদের নিকট থেকে আলু কিনে বাজার দর অনুযায়ী তারা সারা বছর ধরে বেচা-কেনা করবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, এ বছর বীজ আলু বেশি দামে কেনায় ও বাজারে আলুর কাঙ্ক্ষিত দাম না থাকায় কৃষকরা আলু সংরক্ষণে বেশি ঝুঁকছেন। এই কারণেই হয়ত হিমাগারগুলোতে সমস্যা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনজুরুল আলম বলেন, গত বছরের তুলনায় এই বছর আলু বেশি চাষ হয়েছে। তাই আলু সংরক্ষণে কৃষকদের মধ্যে বাড়তি চাহিদা রয়েছে। কৃষকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে হিমাগার ব্যবস্থাপকদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর