
দেশজুড়ে নানা ঘটনা, আলোচনা-সমালোচনা, শঙ্কা ও নাভিশ্বাসের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে ২০২৪ সাল। বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন, ছাত্র আন্দোলন, গণভ্যুত্থান, স্বৈরাচারের পতন ও নতুন সরকার গঠন—এই সবই ঘটেছে। জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের মাধ্যমে, যা সরকারের দমন-নিপীড়নের ফলে গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন। বহু প্রাণের বিনিময়ে দেশের জন্য গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্ব নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এত রক্ত, এত প্রাণ। অন্যায্য কোটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অকাতরে জীবন দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা, সরকারের দমন-পীড়নের নজিরবিহীন সাক্ষী হয়েছে দেশ। অথচ সে কোটা আবারো ফিরিয়ে আনা হচ্ছে জুলাই বিপ্লবের নামে। নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যদের সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলছে সরকার। একই সুবিধা পাবেন গুরুতর আহত ব্যক্তিরাও। এছাড়া সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়েদের পাশাপাশি অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য মোট আসনের ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকবে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
তারা বলেন, যে কোটার বিরুদ্ধে এত কিছু হলো, স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলো- সেই কোটা আবার কেন ফিরিয়ে আনতে চাইছে সরকার। তারা অবিলম্বে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবারের সক্ষম সদস্যরা সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন।
আহতরা তিনটি মেডিকেল ক্যাটাগরি- এ, ক্যাটাগরি বি ও ক্যাটাগরি সি অনুযায়ী সুবিধাদি পাবেন। তাদের পরিচয়পত্র দেয়া হবে এবং পরিচয়পত্র দেখিয়ে সরকারের বিভিন্ন সুবিধাদি পাবেন। অতি গুরুতর আহতরা মাসিক ভাতা এবং বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। উপযুক্ত মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশে দেশি-বিদেশি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাবেন। কর্মসহায়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন সুবিধা পাবেন। এদিকে রোববার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি স্কুলে ভর্তিতে কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে-মেয়েদের পাশাপাশি অভ্যুত্থানে হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের জন্য মোট আসনের ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকবে।
অধিদপ্তরের আদেশটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও স্কুল অ্যান্ড কলেজগুলোর অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম মুখ মহিউদ্দিন রনি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘কোটাকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমরা প্রাণ দেননি। কোটাকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা রাজপথে নামিনি। দফা এক দাবি এক কোটা নট কাম ব্যাক স্লোগান দিয়ে জুলাই গণ- অভ্যুত্থান হয়েছে। আবার কোটার প্রয়োগ জুলাইয়ের কনটেক্সটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি শহীদ পরিবার এবং আহতদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হয় তাদের ভাতা দিন, বাড়ি করে দিন। কিন্তু চাকরিতে কোটা না। কোটা না মেধা, মেধা মেধা। এতদ্রুত এই স্লোগান ভুলে গেলে চলবে না।’
গত ফেব্রুয়ারিতেও জুলাই বিপ্লবের আহত নিহতদের কোটা নিয়ে বিতর্ক হয়। তখন সরকারের তৎকালীন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই শহীদ পরিবারদের এককালীন টাকার পাশাপাশি মাসিক ভাতা ও চাকরির কথা বলা হয়েছে। চাকরিতে এটা কোনো নতুন কোটা হিসেবে যুক্ত হবে না। পরিবারের কর্মক্ষম কোনো একজন ব্যক্তিকে একবারের জন্যই যোগ্যতার বিচারে সরকারি, আধা-সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য এটা বিবেচ্য হবে না। চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন ‘জুলাই শহীদ’ পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন ‘জুলাই শহীদ’- পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যরা। আহতদের ক্ষেত্রে যারা সারা জীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (অন্ধ কিংবা অঙ্গহানি) এবং আর কখনো কর্মক্ষম হতে পারবেন না, তাদের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ রকম আহতদের একটা বড় অংশই তরুণ এবং বাকি জীবন তাদের আন্দোলনের ক্ষত বয়েই বেড়াতে হবে, অনেককে দীর্ঘকাল চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। গতকাল নতুন করে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা প্রয়োগের বিরোধিতা করে সংবাদ সম্মেলন করেছে ছাত্রঅধিকার পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহত পরিবারের সন্তানদের সরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কোটা থাকতে পারে না বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে ছাত্রঅধিকার পরিষদ। ছাত্রধিকার পরিষদ নেতা বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত বা আহতদের পরিবারের সদস্যদেরকেও কোটাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই কোটা বৈষম্যকে বিলোপ করার জন্য যেই ২০১৮ সালে আন্দোলন করেছিলাম। যার ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। কিন্তু আমরা ৭ মাস পার না হতেই দেখছি, যে বৈষম্যবিরোধী চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তিনি আরও বলেন, ছাত্রদের বৈষম্য রোধ করতেই এই ছাত্রঅধিকার পরিষদের জন্ম হয়েছে। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছি। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি। সেই জায়গা থেকে আমরা আবার বলছি, যে কোটাব্যবস্থা চালু রয়েছে, তার বিলোপ সাধন করতে হবে। যদি না করা হয়, ছাত্রঅধিকার পরিষদ তীব্র থেকে তীব্রতর আন্দোলন শুরু করবে।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর