
ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও সুনামগঞ্জে লুটপাট থামেনি বরং বেড়েই চলছে। গত ৬ দিনের ব্যবধানে জেলার দিরাই ও শাল্লা উপজেলার দিনে-দুপুরে হাজার হাজার মানুষ আনন্দ-উল্লাস করে প্রকাশ্যে ৮টি জলমহালে প্রায় ৫ কোটি টাকা মাছ লুট করা হয়েছে। পবিত্র রমজান মাসেও থামেনি মাছ লুটপাট।
স্থানীয় লোকজন ও বিলের ইজারাদার জানিয়েছেন, দিরাই-শাল্লা উপজেলার উজানগাঁও,সোনাকানি,শ্যামারচর,শরিফপুর, কাশীপুর,ললোয়ারচর,মাইতি,কার্তিকপুর,নোয়াগাঁও, চিকাডুপি,বল্লবপুর,মির্জাপুর, নিজগাঁও,রাহুতলা সহ আশপাশের গ্রামের লোকজন দিরাই-শাল্লার কামান ও লাইরা দীঘা জলমহালের মাছ লুটে জড়িত। এছাড়াও জামালগঞ্জ উপজেলার আয়লা ছাগাইয়া জলমহাল লু'ট'পা'ট করা হয়েছে বলে জানাগেছে।
গত শুক্রবার সকালে দিরাই উপজেলার চরনাচর গ্রামের পাশের কামান-কচমা বিলে জোর করে মাছ ধরে নেয় ৫/৭০০ মানুষ। পরদিন শনিবার আবারও ৮-১০ হাজার মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে করে এসে মাছ লুটপাট চালায়। গেল শনি ও রবিবার সকালে শাল্লার যাত্রাপুর গ্রামের পাশের জোয়ারিয়া বিলের মাছ জোর করে ধরে নেয় রঘুনাথপুর,ইয়ারাবাদ,দামপুর ছব্বিশা, কান্দিগাঁও, কান্দকলা, যাত্রাপুর গ্রামের প্রায় হাজার মানুষ। বিলের পাহাড়াদাররা জলমহালে থাকলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
রবিবার সকালে দিরাই উপজেলার মেঘনা-বারঘর জলমহালের একটি বিল ও একই উপজেলার আতনি বিল (শাল্লা উপজেলার জয়পুর গ্রামের সামনে) জোর করে মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ।
এরপর সোমবার দিরাই উপজেলার কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর এলংজুরি ও আলীপুর গ্রামের পেছনের লাইরা-দীঘা ও চনপইট্টা বিলের পাইলের (অভয়ারন্য সৃষ্টি করে মাছ বড় করা) প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশ এলাকার ৮-১০ হাজার মানুষ।
মঙ্গলবার শাল্লা উপজেলার আটগাঁও গ্রামের কাছের কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর সত্তুয়া নদীর মাছ লুট করে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১০-১৫ টি গ্রামের প্রায় ৮-১০ হাজার মানুষ।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে একই উপজেলার কাশীপুর গ্রামের কাছের বাইল্লা বিল ও ইয়ারাবাদ গ্রামের কাছের বড়গাঁও-ইয়ারাবাদ গ্রুপ জলমহালের ভাটিগাং বিল লুটপাট করে স্থানীয় লোকজন।
রমজান মাসে এমন কাজ করা ঠিক না বলায়, শাল্লার আটগাঁও গ্রামের রনি বিল্লালের বসতঘর, অটোরিকশা ভাংচুর করে মটর ও ব্যাটারি খুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার ছোট ভাইয়ের মোটরসাইকেল ভাংচুর করেছে বলে জানিয়েছেন রনি বিল্লাল। এমন ঘটনায় আতংকে আছেন হাওর অঞ্চলের জলমহাল ইজারাদার ও সংশ্লিষ্টরা।
জলমহালের ইজারাদাররা জানিয়েছেন, জলমহালের আশপাশের অন্তত ১০-১৫ টি গ্রামের ৮/১০ হাজার মানুষ আনন্দ-উল্লাসে বিলের মাছ লুট করে নিয়ে গেছে। পুলিশকে জানিয়েও মাছ লুট আটকানো যায়নি। কয়েক হাজার মানুষ একসাথে জড়ো হওয়ায় প্রতিহত করাও সম্ভব হয়নি।
কামান বিলের ইজারাদার চরনারচর বি.এম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি. এর সাধারণ সম্পাদক সুধির বিশ্বাস বলেন,আমরা সরকারকে প্রতি বছর ৫০ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব দেই। দুইদিনে আমাদের বিলের প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। ১৫-২০ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ গাড়ি ভরে নিয়ে গেছে। পুলিশের সামনেই জোর করে মাছ নিয়ে গেছে। পুলিশের কিছু করার ছিল না, কারণ পুলিশ ছিল ১০ জন মাছ ধরতে এসেছিল ৮-১০ হাজার মানুষ।
জোয়ারিয়া বিলের ইজারাদার যাত্রাপুর হিলিপ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি.এর সভাপতি হিমাদ্রী সরকার বলেন,আগামী বছর মাছ ধরার কথা ছিল কিন্তু দুই দিন জোর করে মাছ ধরে আমাদের অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কাশীপুর লাইরা দীঘা গ্রুপ জলমহালের ইজারাদার উত্তর জারুলিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লি. এর সাধারণ সম্পাদক প্রজেশ দাস বলেন, গণহারে লুটপাট চলছে। আমরা প্রতি বছর ৪৫ লাখ টাকা রাজস্ব দেই। আগামী বছর মাছ ধরার কথা থাকলে এলাকার ১০-১৫ হাজার মানুষ দুই দিনে আমাদের জলমহালের কোটি টাকার বেশি মাছ লুটে নিয়ে গেছে। পুলিশকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান,এলাকার লোকজন কিছু বিলের মাছ ধরেছে। লাইরা দীঘা গ্রুপ ফিসারীর পাইলের অংশে জোর করে মাছ ধরার অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম জানান,জোয়ারিয়া বিলে মাছ ধরার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছি। হাজার হাজার লোক ভোরে মাছ ধরতে যায়। বিল গুলো থানা থেকে অনেক দূরে হওয়ায় পুলিশ যাওয়ার আগেই লোকজন চলে যায়। কোন অভিযোগ পাইনি,অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বললেন,দিরাই উপজেলার একটি জলমহাল থেকে জোর করে মাছ ধরে নেওয়ার অভিযোগ পেয়েছি। এছাড়াও আর কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। লুটপাটের সাথে জড়িতদের খোঁজে বের করতে বিষয়টি নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর সাথে কথা বলব।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর