
ফাজিলপুর ওয়ালীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক আহমদ উলাহ সহ কিছুসংখ্যক শিক্ষক এবং তাদের সহযোগী একদল বহিরাগত সন্ত্রাসীর সমন্বয়ে আর্থিক অনিয়ম এর বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।
আর্থিক অনিয়ম ও অপকর্ম ধামাচামা দেয়ার লক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন
সম্প্রতি, মাদ্রাসাটি বন্ধ থাকা অবস্থায় কিছু শিক্ষক ও অর্থ লোপাটের নায়ক প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন খোন্দকার ও শিক্ষক আহমদ উলাহ এর নেতৃত্বে এলাকার কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসীর আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়, সেখানে বন্ধ মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে উপস্থিত করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে, এই সংবাদ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সদ্য সাবেক সদস্যদের পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা প্রদান করা। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকেই কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষক ও এলাকার কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী একত্রিত হয়ে তাদের লক্ষ স্থির করেছে যাতে করে সদ্য সাবেক জিবির সদস্যরা নব ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে যেন অংশগ্রহণ করতে না পারে এবং তাদের উদ্দেশ্য সিন্ডিকেট পছন্দের বাইরে কেউ যেন নমিনেশন পত্র জমা দিতে না পারে।
বিশেষ করে, সদ্য সাবেক কমিটি সদস্যরা নতুন কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি হলে পূর্ববর্তী অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়গুলো সামনে আসতে পারে এমন আশঙ্কায় একটি মহল সক্রিয়ভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে অর্থ লোপাটকারী প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন ও সিন্ডিকেট নায়ক শিক্ষক আহমদ উলাহ তৎপর হয়ে উঠেন।
তাদের আতঙ্কের বিষয় ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদ যদি আবারো সহ-সভাপতি পদে কমিটিতে আসেন তাহলে তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি গোপন করা আর সম্ভব হবে না। ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদ এই প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে তিনি প্রতিষ্ঠানের সকল বিষয় স্বচ্ছতা ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে, কিছু অসাধু শিক্ষক ও প্রিন্সিপালের চক্র তাঁর এই অবস্থান মেনে নিতে পারেনি। এই ভয়ে তারা ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদের নমিনেশন জমা দিতে বাধা দিয়েছে।
এই চক্র ৫ আগস্টের আগে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর হিসেবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সকল অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছে এবং উক্ত মাদ্রাসায় তাদের দলীয় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদের কঠোরতার কারণে তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৩ সাল থেকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা হয়েছে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের স্থানীয় নেতাদের সাথে মিলিত হয়ে এই সন্ত্রাসীরা এবং আহমদ উলাহ’র নেতৃত্বে এই মাদ্রাসাকে সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক আখড়া বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সাবেক কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সহ-সভাপতি ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদ সহ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের কঠোরতার কারণে তাদের এই অ্যাজেন্ডা বা উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, দুর্নীতির প্রকৃত সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মাদ্রাসার লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ সহ সকল অনিয়ম অব্যাহত রাখা। এ কাজে তাদের মদদ দিচ্ছে সমাজের কিছু অসাধু চক্র।
অনিয়ম ও যাকাত তহবিলের অর্থ তসরুপ সহ আর্থিক অনিয়মের কিছু তথ্য
প্রাপ্ত অভিযোগ অনুযায়ী, মাদ্রাসার যাকাত তহবিলের হিসাব দীর্ঘদিন ধরে অস্পষ্ট রয়েছে। প্রতিবছর রমজান মাসে সম্মানিত দাতা সদস্যগণ লক্ষ লক্ষ টাকা মাদ্রাসার যাকাত তহবিলে প্রদান করলেও এর কোনো স্বচ্ছ হিসাব কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়নি।
একইভাবে, কোরবানির ঈদে ৩০০-৪০০টি পশুর চামড়া মাদ্রাসায় আসলেও, সেই অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হয়েছে তা কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়নি।
মাদ্রাসার নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রে কমিটির অনুমোদন ও জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর প্রয়োজন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, লুটপাটকারী চক্র গোপনে প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন ও শিক্ষক আহমদ উলাহ এর যোগসাজশে একটি এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে চারটি পৃথক অ্যাকাউন্ট খুলে মাদ্রাসার অর্থ লেনদেন করছে।
ইসলামী ব্যাংকের ফাজিলপুর এজেন্ট ব্যাংকে পরিচালিত এই লেনদেনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ইসলামী ব্যাংকের এই এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাটি পরিচালিত হয় অত্র সমাজের অত্যন্ত ঘৃণিত ব্যক্তি হোমিও চিকিৎসক ডা. ইউসুফের ছেলে ডা. শাহাদাৎ এবং ফাজিলপুর ওয়ালিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ মাইনুদ্দিনের মাধ্যমে।
এই সিন্ডিকেট সাথে জড়িত রয়েছেন এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান রুহুল আমিনের হত্যা পরিকল্পনা মামলার ১ নাম্বার দাগী আসামি বেলায়েত হোসেন হারুন যিনি এক নামে কোবা হারুন নামে পরিচিত। আরো জড়িত আছেন সাবেক পুলিশ কনস্টেবল মাহবুবুল হক, এলাকায় এবং নিজ বাড়িতে যিনি পাগলা মাহবুব নামে পরিচিত।
বর্তমানে এলাকায় তিনি যে কোন বিষয় নিয়ে হইচই করে এলাকার মানুষের বিরক্তির কারণ। জানা গিয়েছে তার অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খলতা কারণে তাকে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কন্সটেবলের চাকুরি হারিয়ে ফেরত আসতে হয়।
ফেনীর ঐতিহ্যবাহী ফাজিলপুর ওয়ালিয়া মাদ্রাসায় একাধিক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, মাদ্রাসার প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বচ্ছতার অভাব দেখা দিয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে। দাতা সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি, অভিভাবক সমাবেশের তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং বিভিন্ন ফান্ডের অর্থ লেনদেন নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সাবেক সহ-সভাপতি ড. বেলাল উদ্দিন আহমদ তার দুই ছেলের দাতা সদস্যপদ গ্রহণের জন্য সরকার নির্ধারিত ৪,৫০,৯২০/- টাকা মাদ্রাসার ফান্ডে জমা দিয়েছেন। চেক নম্বর ৩৬৯৩২৮৪, তারিখ ১২-১২-২০২৩ এর মাধ্যমে ৩,০০,০০০/- টাকা ইসলামী এজেন্ট ব্যাংক ফাজিলপুর শাখায় জমা হয়েছে, জমার তারিখ ১৩-১২-২০২৩।
এছাড়া, চেক নম্বর ২০৩৭৭৯০, তারিখ ২২-৫-২০২৩ এর মাধ্যমে ১,০০,৯২০/- টাকার চেক নম্বর ২০৩৭৭৮৯১, তারিখ ২২-৫-২০২৩ এর মাধ্যমে ৫০,০০০/- টাকা ফাজিলপুর শাখায় জমার তারিখ ২৪-৫-২০২৩। মোট ৪,৫০,৯২০/- টাকা জমা দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত তাদের নাম দাতা সদস্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
অভিভাবক সমাবেশ ও পাঞ্জেরি প্রকাশনায় দুর্নীতি
২০২৪ সালের অভিভাবক সমাবেশে প্রকাশিত "পাঞ্জেরি" ম্যাগাজিনের জন্য প্রথম পাতার বিজ্ঞাপন বাবদ জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস মঈনুদ্দিন খন্দকারকে নগদ ৪,০০,০০০/- টাকা প্রদান করেছে। এ ছাড়াও পাঞ্জেরীর বিজ্ঞাপন থেকে আরো ১৩,০০,০০০/- টাকা সংগ্রহ হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে ১,৫০,০০০/- টাকা এবং প্রাক্তন ছাত্রদের থেকে ডোনেশন বাবদ ৮,০০,০০০/- টাকা আদায় করা হয়েছে। মোট ২২,৫০,০০০/- টাকা আদায় হলেও এর কোনো স্বচ্ছ হিসাব কমিটির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়নি। প্রত্যেক জিবির মিটিঙয়ে সহ-সভাপতি ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদ হিসাব উপস্থাপনের তাগিদ দিলেও শেষ পর্যন্ত উপস্থাপন করা হয়নি।
২০২২ সালের অভিভাবক সমাবেশে একইভাবে পাঞ্জেরি প্রকাশনার মাধ্যমে ১১,০০,০০০/- টাকা, প্রাক্তন ছাত্রদের থেকে ৯,০০,০০০/- টাকা এবং অন্যান্য ডোনেশন থেকে ২,০০,০০০/- টাকা সংগ্রহ করা হয়। দুই বছরে অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে মোট ৪৪,০০,০০০/- টাকা আয় হলেও এই অর্থের কোনো হিসাব কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়নি ও অনুমোদন নেয়া হয়নি।
তহবিল অনিয়মের আরো তথ্য
পরীক্ষার্থী তহবিল, আবাসিক তহবিল ও যাকাত তহবিলের হিসাব প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ বইতে অন্তর্ভুক্ত না করে গভর্নিং কমিটির অনুমোদন ছাড়া পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেট দল এসব তহবিল থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এই দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় সাবেক সহ-সভাপতি ড. বেলাল উদ্দিন আহমেদ ও সদস্য মো. মূসাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে এবং বিভিন্ন অসৎ, মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায়
২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১৮০০ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কোনো রশিদ ছাড়া লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করেছেন মাদ্রাসার শিক্ষক আহমদ উলাহ। এই অর্থের কোনো যথাযথ হিসাব দেয় নেই, যা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা সম্ভব।
প্রশাসনিক তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি
অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থ লুটপাটের ঘটনা ধামাচাপা দিতে কিছু দুষ্কৃতিকারীকে নগদ টাকা প্রদান করা হয়েছে। এলাকাবাসী ও অভিভাবকরা মাদ্রাসার অর্থ ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
তারা আশা করছেন, তদন্তের মাধ্যমে মাদ্রাসার অর্থ লোপাটকারী সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিচারের আওতায় এনে ৭২ বছরের ঐতিহ্যবাহী ফাজিলপুর ওয়ালিয়া মাদ্রাসার ঐতিহ্য রক্ষা করা হবে।
তবে গত বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) মাদ্রাসার শিক্ষকরা এ বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন এবং গৃহীত সকল অভিযোগ অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্য মূলক ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর