
প্রতিনিয়তই যেন আতঙ্ক নিয়ে বাস করতে হয় রাজধানী ঢাকায়। সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেল গত কয়েকদিনের ভুমিকম্প। ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশ তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ফলে প্রবল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা না হলেও ভূমিকম্পের ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশে কয়েক দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। এসব ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যায়, এ অঞ্চলে ভূগর্ভে দুটি প্লেট ধাবিত হচ্ছে। ইন্ডিয়া প্লেট পূর্বদিকে যাচ্ছে। বার্মা প্লেট পশ্চিমের দিকে আসছে। বার্মা প্লেটের নিচে ইন্ডিয়া প্লেট তলিয়ে যাচ্ছে। এটিকে বলে ‘সাবডাকশান জোন’।
ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। জিপিএসে পরিমাণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছর ১ মিটার থেকে দেড় মিটার সংকোচন হচ্ছে। সে হিসাবে এখানে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। যে কোনো সময় এ ভূমিকম্প হতে পারে।
ভূমিকম্প এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এই মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ঢাকা নগরী। অপরিকল্পিত শহর এবং বিল্ডিং কোড মেনে অনেক স্থাপনা নির্মাণ না হওয়ায় এখানকার ১ শতাংশ বিল্ডিংও যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে দুই লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটবে। ৫-৭ লাখ মানুষ বিভিন্ন বিল্ডিংয়ে আটকা পড়বে।
পরবর্তী সময়ে খাদ্যাভাব, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা কারণে তাদেরও একটি বড় অংশের মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প থেকে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের সময় এলাকাভেদে একেক রকম হয়। এ ভূখণ্ডে বড় ধরনের ভূমিকম্প সাধারণত এক থেকে দেড় হাজার বছর পরপর হয়ে থাকে। ১৭৬২ সালে ‘গ্রেট আরকান আর্থকোয়েক’-এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এতে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার। এসব হিসাবেও বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ৪১টি ভূমিকম্প হয়। গত বছর তা ছিল ৫৪।
এদিকে ২০০৮ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে দেশে ভূমিকম্প হলে তার জন্য প্রস্তুতি কেমন-এ বিষয়ে একটি কমিটি করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সেই কমিটি এখন কাজ করছে। হাইকোর্টের আরেক নির্দেশনায় ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, কী কী যন্ত্রপাতি আছে, নগরীকে কীভাবে আবার আবাসযোগ্য করা হবে-সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এসব বিষয়ে এরই মধ্যে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বর্তমানে ১২ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প চলমান আছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।
জানা যায়, দেশে এখন যে লেডার আছে, তা দিয়ে বিশতলা পর্যন্ত ওঠা যায়। ৬২ হাজারের টার্গেট নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার আরবান ভলান্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ হলে মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএম) নিতাই চন্দ্র দে সরকার বলেন, যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে-বিষয়টি অনেক আগে থেকেই বলা হয়েছে। আমরা সে বিবেচনায় রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, তাৎক্ষণিকভাবে কী করা উচিত-সেসব বিষয়ে পরিকল্পনা করেছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ রংপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জের জন্য রিস্ক অ্যাসেসেমন্ট করা হয়েছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতি অত্যাবশ্যক। এ জায়গায় এখনো ঘাটতি আছে। প্রস্তুতির চেয়ে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারে করণীয় এবং বিভিন্ন কেনাকাটায় মনোযোগ বেশি।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার বিষয়ে কোনো শিক্ষা নেই। সচেতনতাবোধ নেই। সরকারের প্রস্তুতির অভাব। সরকারের প্রস্তুতি মূলত ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজে। এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভূমিকম্পের আগে ব্যক্তি পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কী কী থাকা দরকার, সেখানেও তেমন কোনো অর্থ ব্যয় নেই।
তিনি বলেন, যে কোটি কোটি টাকা বাজেট আছে, এর ১ শতাংশও যদি স্মার্টফোনে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড গেম চালু করা হয়, তাহলে তিন থেকে ছয় মাস সময়ের মধ্যে সবাই এটি শিখে যাবে। ভূমিকম্প হলে ঘরের ভেতরে থাকলে কী করতে হবে। কীভাবে আশ্রয় নিতে হবে, বাইরে থাকলে কী করণীয়-এসব শিখে নেবে। শিক্ষিত করার পর মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি নিয়মিতভাবে হতে হবে। মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এটি। এ প্রস্তুতি না নিয়ে উদ্ধারকাজের প্রস্তুতি নিলে ভূমিকম্পেই যদি সব নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে উদ্ধার কে করবে। কোন এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেডিকেল টিম, রেসকিউ টিম পাঠানো, রিলিফ পাঠানো-এসবেরও সঠিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা প্রয়োজন।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর