
১১ মাস ব্যবসা করেন রফিকুল ইসলাম রফিক। প্রতি মাসে লাভের অংশ থেকে আলাদা করে জমা করেন কিছু অর্থ। সেই অর্থ দিয়ে তিনি পুরো রমজান মাসে টাকা ছাড়াই গড়ে তিনশ জনকে সেহরি ও ইফতার করাচ্ছেন।
গত দশ বছর ধরে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌরশহরের কাঁচা বাজারে রফিক হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম রফিক এমন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি রমজানের শুরু থেকে প্রতিদিন গড়ে তিনশজন রোজাদার ব্যক্তিকে বিনা টাকায় সেহরি এবং ইফতার করাচ্ছেন। অনেক টাকার মালিক না হলেও সারা বছর যা আয় করেন সেখান থেকে কিছু টাকা সঞ্চয় করে রমজান মাস জুড়ে তিনি সেহরি ও ইফতার করান। বছরের এগারো মাস ব্যবসা করলেও রমজানের এক মাস মেহমানদারি করান তিনি। সাথে ১২ জন কর্মচারীও বিনা অর্থে মালিকের সাথে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।
হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, রমজান মাসে শহরের অধিকাংশ খাবারের হোটেল বন্ধ থাকে। ইফতারি ও সেহরির সময় রোজাদারদের অনেক কষ্ট হয়। বছরের এগারো মাস আমি হোটেল ব্যবসা করি। লাভও হয়, তা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রেখে রমজান মাসে শহরে বিপদগ্রস্ত ও ছিন্নমূল রোজাদারদের ইফতার ও সেহরি খাওয়ানোর চেষ্টা করি। ২০১৬ সাল থেকে এই কার্যক্রম শুরু করেছি। এ কাজে আমার হোটেলের কর্মচারীরা সহযোগিতা করে। তারাও এই মাসে কোন পারিশ্রমিক নেয় না। মূলত পরকালের মুক্তি এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই আমি এই কাজ করে আসছি এবং যতদিন বাঁচবো এটা যেন চালু রাখতে পারি এজন্য আপনারা দোয়া করবেন।
বুধবার রাতে সেহরির সময় রফিক হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, আক্কেলপুর কলেজ বাজারের কাঁচা মালপট্টিতে রফিকের হোটেলে সেহরি খাওয়ার ভিড় চখে পড়ার মত। ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, টেবিলে বসে যে যার মত করে খাবার খাচ্ছেন। মালিকসহ কর্মচারীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। খালি নেই কারও হাত। হোটেল জুড়ে চলছে জমজমাট সেহরি পর্ব। খাবার খেয়ে টাকা না দিয়েই চলে যাচ্ছেন সবাই। টাকা না দিয়ে সেহরি খাবেন সবাই এটাই রোজার একমাস ধরে রফিক হোটেলের নিয়ম। এই নিয়মটি তিনি গত দশ বছর ধরে চালু করেছেন।
জানা গেছে, হোটেল মালিক রফিক ধনাঢ্য ব্যক্তি নয়। তিনি বছরের এগারো মাস হোটেলের ব্যবসা করেন। এই আয় দিয়ে রফিক পুরো বছর সংসার চালান। পাশাপাশি রমজান মাসে বিপদগ্রস্ত ও ছিন্নমূল রোজাদারদের টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতার খাবারের জন্য টাকা জমানো। প্রতি বছর রোজার শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত তিনি এসব রোজাদারদের টাকা ছাড়াই সেহরি ও ইফতারি খাওয়ান। মহান আল্লাহপাকের কৃপায় তিনি এই মহৎ কাজ করে আসছেন এবং বেঁচে থাকা অবস্থায় করে যাবেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হোটেল মালিক রফিকুল ইসলাম রফিক অন্যের জায়গা ভাড়া নিয়ে হোটেল ব্যবসা করে আসছেন। পৌরশহরেই তার বসবাস। ২০১৬ সাল থেকে তার হোটেলে টাকা ছাড়াই রমজান মাসের ত্রিশদিন সেহরি ও ইফতার করাচ্ছেন। বিশেষ করে ব্যবসায়ী, হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আসা স্বজনরা, স্টেশনে আসা যাত্রীরা টাকা ছাড়াই নিয়মিত সেহরি ও ইফতারি খাচ্ছেন। হোটেল মালিক রফিকুল নিজে এবং তার হোটেলের কর্মচারীররা মিলে ইফতারি ও সেহরির খাবার পরিবেশন করেন। গরুর মাংস, মাছ, ভাজি, ডাল শেষে এক গ্লাস করে দুধ দিয়ে সমাপ্ত হয় সেহরি পর্ব। আর ইফতারিতে থাকে বিরিয়ানি, ছোলা বুট, বুন্দা, মুড়ি, পিঁয়াজু, বেগুনি সাথে এক গ্লাস শরবত। রোজাদাররা তৃপ্তি সহকারে সেহরি ও ইফতার করছেন। হোটেলের অভ্যন্তর ছাড়িয়ে বাহিরে হাটের জায়গায় ডেকোরেটরের কাপড় বিছিয়ে ইফতার করানো হয়।
সেহরি খেতে আসা রমজান আলী বলেন, আমি কাঁচা মালের ব্যবসা করি। প্রায় সময়ই বাহির থেকে মাল ক্রয় করে মোকামে নিয়ে যাই। আজ আক্কেলপুরে আলু ক্রয় করতে এসেছি। সেহরি খাওয়া নিয়ে খুবই চিন্তায় ছিলাম। লোকমুখে শুনে রফিক হোটেলে এসে দেখি সবাই সেহরি খাচ্ছে। খাওয়ার পর টাকা দিতে চাইলেও সে কোন টাকা নেয় না। সকলকে ফ্রিতে ইফতার এবং সেহরি খাওয়ানোই তার ইচ্ছা। অনেক চেষ্টা করেছি টাকা দিতে পারিনি।
ক্ষেতলালের দেউগ্রামের বাসিন্দা জাহানারা বেগম বলেন, হাসপাতালে আমার ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে এসে ভর্তি করেছি। রাতে সেহরি খাওয়ার জন্য হোটেল খুঁজতে ছিলাম। এই হোটেলে এসে দেখি অনেকে খাবার খাচ্ছে। আমি বসার পর অর্ডার না দিতেই বয় এসে খাবার দিয়ে গেল। তখনও বুঝিনি খাবারের বিষয়টি। বিল দিতে গিয়ে জানতে পারলাম তিনি টাকা না নিয়ে সেহরি খাওয়ান। তার এই কার্যক্রম আমার মতো অনেক বিপদগ্রস্ত লোকের উপকার হয়।
কথা হয় সবজি ব্যবসায়ী আবু বক্করের সাথে, তিনি বলেন, খুব সকালে কাঁচা মাল কিনতে বাজারে আসতে হয়। তাই রাতেই এখানে এসেছি। টাকা ছাড়াই সেহরি খেলাম এই হোটেলে। বিষয়টি আমার খুব ভাল লেগেছে। সমাজে অনেক ধনাঢ্য মানুষ রয়েছে, তারাও এমন কাজ উদ্যোগ নেন না।
আক্কেলপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আলাউদ্দিন নামে এক কর্মচারী বলেন, আজ রাতে আমার ডিউটি। শেষ রাতে বাসায় গিয়ে সেহরি খাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। বাড়ি না গিয়ে এখানেই সেহরি খেলাম। আজ মাংস, সিম ভাজি, ডাল এবং এক গ্লাস দুধ দিয়ে সেহরি করেছি। তার জন্য দোয়া করি।
হোটেল কর্মচারী বুদা মিয়া বলেন, মালিক যেখানে একমাস ধরে ৩’শ থেকে সাড়ে ৩’শ জনকে টাকা ছাড়াই ইফতার ও সেহরি করাচ্ছে, সেখানে একটু শ্রম দিলে সমস্যা কি ? ১১ মাস বেতন নিয়ে কাজ করি, এক মাস শুধু খাবার দেয়। তাছাড়া ঈদে বেশি করে বোনাস দেয়। তাতে ভালো লাগে।
বুধবার দুপুরে নওগাঁর আত্রাই থেকে মাছ নিয়ে আসেন শামিম হোসেন। তিনি বলেন, মাছ বিক্রি শেষে এখানে ইফতারের সময় হওয়ায় রফিক হোটেলে গিয়ে ইফতার করেছি। আমার কাছে ইফতারির টাকা নেয় নি। আমার মতো অনেকেই ইফতার করেছেন। হোটেলের মালিক কারও কাছে টাকা নেন না। শুনেছি রোজা এক মাস তিনি টাকা ছাড়াই সবাইকে ইফতার ও সেহরি খাওয়ান।
আক্কেলপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোমেন বলেন, রফিক সামান্য একজন হোটেল ব্যবসায়ী। তাঁর এমন উদ্যোগ জেলার মধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এতে বাহির থেকে আগত রোজাদাররা অনেক উপকৃত হন। এটি একটি মহৎ কাজ। রফিক গরিব হলেও তার মন অনেক বড়। এই শহরে বড় বড় অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। কেউ এমন উদ্যোগ নেওয়া তো দূরের কথা, মুখে আনতেও সাহস পায়নি। অর্থ থাকলেই হয়না, মনও থাকতে হয়। রফিক একজন মানবতার ফেরিওয়ালা।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর