
চাঁদপুর - জামালপুরের পর অপকর্মের নতুন আস্তানা গেড়েছেন আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা এডি দিদারুল। জাতীয় পুলিশের আলোচিত ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক (এডি) একেএম দিদারুল আলমের অপকর্মের লিস্ট ক্রমেই বড় হচ্ছে।
তার নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের পর গেল ২৫ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য ) সহকারী পরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জেলা কার্যালয়, কক্সবাজারে যোগদান করেব এ, কে, এম দিদারুল আলম। সেখানেও এবার এক সাংবাদিককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে এই আলোচিত পুলুশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, আটক এক আসামিকে শিখিয়ে স্থানীয় অনলাইন চ্যানেল ডেকে লাইভ সম্প্রচার করা হয়েছে, যা কক্সবাজার মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটেছে।
রবিবার (৯ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে সাংবাদিক শাহিন মাহমুদ রাসেল তার ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে এক নারী অভিযোগ করেন যে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা দিদারুল আলম তার স্বামীকে (সিএনজি চালক বজল করিম) মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। পোস্টের ক্যাপশনে সাংবাদিক রাসেল লেখেন,
"অপকর্মে মশগুল মাদকদ্রব্যের এডি দিদারুল। মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া সিএনজি চালক বজল করিমের স্ত্রী রাশেদার আহাজারি!!"
সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল জানান, এক সিএনজি চালককে (বজল করিম) কোনো মাদক ছাড়াই দীর্ঘক্ষণ আটক রাখা হয়েছিল। এ বিষয়ে সহকারী পরিচালক দিদারুল আলমের সঙ্গে ফোনে কথা হলে বাকবিতণ্ডা হয়, তখন দিদারুল তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। কিছুক্ষণ পর চালকের স্ত্রী রাসেলকে ফোন করে জানান, তার স্বামীকে আর ছাড়বে না বলে কর্মকর্তারা হুমকি দিয়েছেন।
এরপর রাসেল ওই নারীর ভিডিও বক্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করলেই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে রাত সাড়ে ৯টায় মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের কার্যালয়ে আগে থেকে আটক থাকা এক আসামিকে শিখিয়ে সাংবাদিক রাসেলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ানো হয় এবং সেটি লাইভ সম্প্রচার করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো অপরাধী শত্রুতাবশত বা কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে যে কারো নাম বলতে পারে। তাই এমন অভিযোগ যাচাই না করে প্রচার করা আইনসম্মত নয়।
এই ঘটনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ডিএনসি) কাজী গোলাম তওসিফ বলেন,"এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনারা লিখিত অভিযোগ দিন, আমি ডিজিকে বলে দিচ্ছি, দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।"
এদিকে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মমতাজ তানভীর এবং চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, "কোনো আসামি আদালতে স্বীকারোক্তি না দিলে বা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে অন্য কারও নাম উল্লেখ না করলে তাকে আসামি করা যায় না। পাবলিক প্লেসে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কাউকে অভিযুক্ত করাও আইনসিদ্ধ নয়। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি।"
এডি দিদারুল আলম ২০১৩ সাল থেকে একই পদে দায়িত্বে রয়েছেন, আওয়ামিলীগের আমল থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করে নানা অপকর্মে জড়িয়ে সমালোচিত হয়ে আসছে। ২০২৩ সালে চাঁদপুর কার্যালয় থেকে জামালপুর বদলির আদেশ পেলেও নানা অপকর্মের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে "এডি দিদারুল, নানান অপকর্ম ও নারীতে মশগুল" শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
ঘটনার বিষয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
দৈনিক ইত্তেফাক ও জাগো নিউজ-এর কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি সাইদ আলমগীর বলেন, "একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন নাটক সাজানো চরম অন্যায়। আমরা চাই, তদন্ত করে এর সঠিক বিচার করা হোক।"
দৈনিক যুগান্তর-এর কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি জসিম উদ্দিন বলেন, "একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না। দিদারুল আলমের আগের অপকর্মগুলোর তদন্ত হওয়া উচিত।"
কক্সবাজার জেলা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দৈনিক মেহেদী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, "সাংবাদিকরা যদি মিথ্যা মামলার শিকার হন, তাহলে মুক্ত গণমাধ্যম হুমকির মুখে পড়বে। প্রশাসনের উচিত নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।"
দৈনিক সকালের সময়-এর কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি সাহেদ ফেরদৌস হিরো বলেন, "প্রশাসনের উচিত সাংবাদিকদের হয়রানি না করে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এই ধরনের ঘটনা সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।"
স্থানীয় সাংবাদিক মহল ও সচেতন মহল এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দিদারুল আলমের অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে অন্য সাংবাদিকরাও একই ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারেন।
এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়!
এর আগে, চাঁদপুরে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের পর গেল ২ অক্টোবর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) জামালপুর কার্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক পদে বদলি করা হয় এ কে এম দিদারুল আলমকে। সেখানে গিয়েও অনিয়মের একই ধারা জারি রাখেন তিনি। তাঁর অধীনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাঁর আচরণে নাখোশ। এডি দিদারুলের অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরে গত ২৭ নভেম্বর পুলিশের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁর বিরুদ্ধে ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ
ওই অভিযোগে বলা হয়, চাঁদপুর থেকে জামালপুরে এসেও দিদারুলের অপকর্ম থেমে নেই। ২ নভেম্বর জামালপুরের যৌনপল্লিতে দলবল নিয়ে অভিযানে যান দিদারুল। আভিযানিক দলের সদস্যদের বাইরে থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি যৌনপল্লির অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক ও গাঁজা কারবারি নারীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেন। এ সময় আভিযানিক দলের এক সদস্য কৌশলে দূর থেকে মোবাইল ফোনে এ ছবি তোলেন। বিষয়টি টের পেয়ে ঘটনাস্থলেই ওই সদস্যের সঙ্গে অসদাচরণ করার পাশাপাশি মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ছবি মুছে দেন। একই দিন মাদক মামলার পলাতক আসামি আবদুল হালিমকে ধরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন।
অভিযোগের সত্যতা জানতে গত সোমবার মোবাইল ফোনে কথা হয় হালিমের ছেলে মেহবুব রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাদক মামলায় তাঁর বাবার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। দুই লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁর বাবাকে দিদারুল ছেড়ে দেন।
ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো অভিযোগপত্রে দিদারুলের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে টাকা তুলে না দিলে পরিদর্শকসহ অপর সদস্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। দিদারুলের সঙ্গে চাকরি করতে অনীহা প্রকাশ করে জামালপুর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বেচ্ছায় বদলি চান।
এ অভিযোগের এক দিন পর ২৯ নভেম্বর দিদারুলও ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে পাল্টা অভিযোগ করেন তাঁর অফিসের পরিদর্শক তারেক মাহমুদের বিরুদ্ধে।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর