
দুই ভাই মানসিক ভারসাম্যহীন। মা মারা গেছেন ১০ বছর আগে। বাবা কৃষক। পরিবারের হাল ধরার মতো তেমন কেউ নেই। তাই ইউরোপের দেশ ইতালি যেতে চেয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সী যুবক সুমন হাওলাদার। স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষক বাবার কষ্ট লাঘব করে পরিবারে ফিরিয়ে আনবেন সচ্ছলতা। কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে ভূমধ্যসাগরে।
অবৈধভাবে সমুদ্রপথে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার সময় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আগুন ধরে নিহত হয়েছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের চর মোস্তফাপুর গ্রামের আবু হাওলাদারের ছেলে সুমন হাওলাদার। একই সঙ্গে নিহত হন উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় গ্রামের সিদ্দিক মাতুব্বরের ছেলে নাসির মাতুব্বর (৩৫)। এ ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকেই। তবে নিহতদের মরদেহ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।
স্থানীয়রা জানান, ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর আশায় সাগর পথে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে বের হন সুমন হাওলাদার (২৬)। লিবিয়া পৌঁছে ৪ মার্চ ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওয়ানা দেন সুমনসহ আরও ১০-১৫ জন যুবক। মাঝপথে ভূমধ্যসাগরে নৌকার ইঞ্জিন ফেটে আগুন ধরে যায়। এ সময় ভয়ে নৌকা থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়লে ডুবে যান সুমন। একইভাবে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় শাখারপাড়ের নাসির মাতুব্বরের। রোববার (৯ মার্চ) তাদের মৃত্যুর খবর এলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্বজনরা জানান, মানবপাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য রাজৈরের শাখারপাড়ের আলী মোল্লার ছেলে আরিফ মোল্লার মাধ্যমে সুমনকে ১৭ লাখ টাকা চুক্তিতে পাঠানো হয়েছিল এবং ১৬ লাখ টাকা চুক্তি করে নওগাঁর দিপু দালালের মাধ্যমে গিয়েছিল নাসির। কথা ছিল লিবিয়া দিয়ে ইতালি নেবে।
সুমনের দুলাভাই আল আমিন বাঘা জানান, ১৭ লাখ টাকা চুক্তিতে আরিফ দালালের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল সুমনকে। ৩ মার্চ দিবাগত রাতে তাদের গেম দিয়েছিল। তারপর শুনি সুমনের কোনো খবর নেই। শুনছি বোটে নাকি পানি উঠে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে তার জোড়া লাগাতে গিয়ে ইঞ্জিন ফেটে আগুন ধরে যায়। এ সময় সুমন বোট থেকে লাফ দিয়ে সাগরে পড়ে মারা গেছে। কিন্তু এখনো মরদেহ পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাসিরের বোন পরিচয়ে এক নারী জানান, দালালের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমার ভাইয়ের হায়াত এ পর্যন্তই ছিল। দালালরা তাকে স্পেশাল বোটে ডাবল ইঞ্জিন দিয়ে পাঠিয়েছিল। ভাগ্যে নেই। তবে লাশ এখনো দেখি নাই। আমাদের বিশ্বাস যদি বেঁচে থাকে তাহলে আমার ভাইয়ের সাথে একদিন কথা হবে।
এ ব্যাপারে জানতে মানবপাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য আরিফ মোল্লার বাড়ি রাজৈর উপজেলার গাংকান্দী শাখারপাড় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে পরিবারের সদস্যরা জানান, আরিফ ৩ মাস যাবত লিবিয়া থাকেন। কিন্তু তিনি কোনো লোক ইচ্ছা করে নেননি। বাড়িতে এসে জোর করে তার বাবা আলী মোল্লার কাছে পাসপোর্ট ও টাকা দিয়ে গেছে।
অভিযুক্ত আরিফ মোল্লার খালু মো. রাশেদ হাওলাদার বলেন, আলী (আরিফ মোল্লার বাবা) একজন কৃষক। জমিজমা চাষ করে খায়। তার ছেলে আরিফ মাত্র ৩ মাস হইছে লিবিয়া গেছে। এরই মধ্যে আরিফ তার বোন জামাইকে ইতালি পাঠাইছে। সেজন্য আশপাশের লোকজন আরিফের বাবা আলীকে অনুরোধ করে লোক পাঠানোর জন্য বলছে। এ পর্যন্ত ২০ থেকে ৩০ জনের মতো লোক নিয়েছে। কিন্তু আরিফ কোনো দালাল না।
চলতি বছর অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে জেলার অন্তত ১৬ জন যুবক মারা গেছেন। এর মধ্যে গত ২৪ জানুয়ারি মৃত্যু হয় রাজৈর উপজেলার ১০ যুবকের। এমন ঘটনায় জড়িত মূলহোতারা বার বার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাদারীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী সুজন ভৌমিক ও আনোয়ার হোসেন আরমিন।
মাদারীপুরের রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাসুদ খান বলেন, আমরা তথ্য পেয়েছি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে দুইজন নিহত হয়েছেন। তবে ভিকটিমদের পরিবার আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও মূল মানবপাচারকারীরা দেশে না থাকায় এগুলো নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এখানে যারা থাকে আর আমরা যাদের ধরি তারা সব থার্ড পার্টি। বেশিরভাগ মানবপাচারকারীরা লিবিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর