
কক্সবাজারের শহরের প্রবেশমুখ লিংক রোড সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে গত ৯ মার্চ সিএনজি ড্রাইভার বজল করিম নামের এক ব্যক্তিকে সকাল ১০ ঘটিকায় আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কক্সবাজার শাখা। এসময় মাদকদ্রব্যের একাধিক কর্মকর্তা তার সিএনজি কয়েকধাপে চেক করে কিছুই পায়নি। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঘটনাস্থল থেকে ৮ কিলোমিটার দূরবর্তী ঝাউতলা গাড়ির মাঠে। সেখানে গিয়ে আটক বজল করিমের স্ত্রীকে ডেকে দাবি করা হয় ৫ লাখ টাকা। অন্তত ৫ ঘণ্টা ধরে চলে দরকষাকষি। তবে সিএনজি চালক বজলের স্ত্রী টাকা দিতে না পারায় বিকেল ৩ টার দিকে ১৮০০ পিস ইয়াবা দিয়ে ছবি তুলে তা প্রকাশ করা হয়।
একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, আটকের সময়, মামলার এজাহার ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বিডি২৪লাইভ। তবে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে না পারলেও টাকা দাবির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিদর্শক মো. তায়রীফুল ইসলাম বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ৯ মার্চ সকাল সাড়ে দশটায় খবর পেয়ে সহকারী পরিচালক দিদারুল আলমের দিকনির্দেশনায় দুপুর ১ টার দিকে বজল করিমকে সিএনজিতে অবস্থানরত অবস্থায় আটক করা হয়। সিএনজি দুপুর দেড়টার দিকে ঝাউতলা গাড়ির মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে দুপুর ২টার দিকে অবস্থায় গাড়ির ভেতরে থেকে ৯ প্যাকেটে ১ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা সদৃশ ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।
বিডি ২৪ লাইভের অনুসন্ধান, ঘটনাস্থলের একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে মামলার এজাহারের সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কোন মিল পাওয়া যায়নি। এছাড়াও মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারাও ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ৯ মার্চ সকাল ১০ টা ৭ মিনিটে ডিএনসির কর্মকর্তারা সিভিলে বজল করিমকে আটক করে ধরে তার সিএনজির কাছে নিয়ে আসে। ১০ টা ১৬ মিনিট পর্যন্ত সিএনজির চেক করে কিছুই না পাননি। এরপর মাদকের কর্মকর্তারা সিএনজি ড্রাইভার বজলকে নিয়ে যান ঘটনাস্থল থেকে ৮ কিলোমিটারেরও বেশি দূরের কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা গাড়ির মাঠ নামক জায়গার একটি গ্যারেজে। সেখানে বিকেল ৩ টা অবধি তাকে আটকে রেখে প্রথমে ৫ লাখ পরে ৩ লাখ টাকা দাবির অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী বজলের স্ত্রী রাশেদা বেগম।
জানতে চাইলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সিএনজির লাইনম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ভোর ৫ টায় বজল ভাই স্ট্যান্ডে এসে সিএনজির সিরিয়াল দেয় এবং ৫টা থেকে উনি স্ট্যান্ডেই ছিল। দুইটা গাড়ির পরেই তার সিরিয়াল ছিল। গাড়ি স্ট্যান্ডে রেখে সে আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছিল। এমন সময় মাদকদ্রব্যের কর্মকর্তারা তাকে আটক করে গাড়ি চেক করে। চেক করে কিছু না পেয়ে নিয়ে যেতে চাইলে আমরা বাঁধা দেই। তখন মাদকের কর্মকর্তারা বলেন, ‘ওনার কাছে যেহেতু কিছু পাই নাই ওনার সমস্যা নাই। প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আছে সেটা জিগ্যেস করে ছেড়ে দিব।’
ঘটনার আরও একজন প্রত্যক্ষদর্শী লিংরোড সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম। ড্রাইভার বজলকে আটকের কথা শুনেই তিনি ঘটনাস্থলে আসেন। তার ভাষ্যমতে, মাদকের কর্মকর্তারা প্রথমে তাকে ডিবির অফিসার হিসেবে পরিচয় দেন। আনোয়ারুল ইসলাম প্রথমে কক্সবাজার ডিবিতে খবর নেন। সেখানে পাননি। পরে তিনি জানতে পারেন বজলকে ঝাউতলা গাড়ির মাঠে নিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর তিনি ওখানে ছুটে যান।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গিয়ে জিগ্যেস করি তাকে কেন ধরে আনা হয়েছে। তখন ওখানে থাকা চাকমা (তন্তুমনি চাকমা) অফিসার বলেন, আমি কিছু বলতে পারব না। এটা স্যার (এডি দিদারুল) ডিল করতেছে। আপনি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়াও আরও কয়েকজন কনস্টবল আমাকে জানান, ‘ওনার কাছে কিছু পাওয়া যায় নাই। ওনাকে আমরা ছেড়ে দিব। আপনি একটু ওয়েট করেন, স্যার আসুক।’ পরে আমি ওয়েট করতে থাকি, তাদের স্যার আর আসে না। প্রায় ৪ ঘণ্টা পরে এডি দিদারুল এসে চোখ গরম করে গালাগালি করতে থাকে। আর বলে ওকে হ্যন্ডকাপ লাগাও। তখন দিদারুলের নিজের হাতে নিয়ে আসা একটি ব্যাগের ভেতর থেকে ইয়াবার প্যাকেট বজলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলতে থাকে। উনি সাথে করে সাংবাদিক নিয়ে যান, সেই সাংবাদিক ভিডিও করে। আমি কথা বলতে গেলে দিদারুল আমাকে ধমক দেয়।’
একই ধরনের কথা বলেছেন, বজলের স্ত্রী রাশেদা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি ঝাউতলা মাঠে গেলে তাদের একজন লোক আমার কাছে প্রথমে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। পরে দিদারুল স্যার ৩ লাখ টাকা দিতে বলে। ৩ লাখ টাকা দিলে আমার স্বামীকে ছেড়ে দেবে বলে জানায়। কিন্তু টাকা না দিতে পারায় দিদারুল তার সাথে করে নিয়ে আসা ব্যাগের ভেতর থেকে ইয়াবা বের করে আমার স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলে।’
সহকারী পরিচালক দিদারুলের সাথে করে নিয়ে আসা সাংবাদিকের ভিডিওটি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেই ভিডিওতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যর সত্যতা পাওয়া যায়। ভিডিওটির প্রথম ৩ সেকেন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম সেকেন্ডে দেখা যায়, দিদারুলের পাশে থাকা মাদকদ্রব্যের সিপাই মো. মনির হোসেন একটি ব্যাগ থেকে ইয়াবা বের করে বজলের হাতে দিচ্ছেন। মনির হোসেনের বাম হাতে ব্যাগ আর ডান হাত দিয়ে ইয়াবা দিতে দেখা যায় হ্যান্ডকাফ পরা বজল করিমের হাতে।
এরপর সেখানে একটি বক্তব্যে সহকারী পরিচালক দিদারুল বলেন, আমার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে কলাতলী থেকে আটক করেছি। তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছিলেন। অথচ তাকে আটক করা হয় লিংক রোড থেকে। লিংক রোড থেকে কলাতলীর দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। আবার গাড়ি চেক করা হয় ঝাউতলা, লিংক রোড থেকে ঝাউতলার দূরত্ব ৮ কিলোমিটারের বেশি।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক একেএম দিদারুল আলক বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উখিয়া থেকে মাদকের চালান নিয়ে যাওয়ার সময় সিএনজি থামিয়ে বজল মিয়াকে মাদকসহ আটক করা হয় বলে জেনেছি।’ প্রতিবেদকের হাতে থাকা একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিওর বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চাইলে মাদকের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই বিষয়ে কিছু জানি না। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিটিংয়ে ছিলাম। ঘটনাটি জেনেছিই দুপুর ১ টার দিকে। এমন কিছু হয়ে থাকলে অভিযানে থাকা অফিসাররা করেছে।’ ৫ লাখ টাকা দাবির বিষয়টিও অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে মামলার বাদি মো. তায়রীফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাকে দুপুর ১২ টা বা ১ টার দিকে স্ট্যান্ড থেকে আটক করি।’ সিসিটিভি ফুটেজে ১০ টায় আটকের বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এরপর সকাল ৫টা থেকে স্ট্যান্ডে থাকা সিএনজি কীভাবে উখিয়া থেকে আসল— এমন প্রশ্নেও তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এরপর লিংক রোডে আটক করে ৮ কিলোমিটার দূরে ঝাউতলা কেন নেয়া হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন— এটি কোন ভ্যালিড প্রশ্ন নয়। আমরা মাদক পেয়েছি, আপনি দরকার হলে আসামি জামিনে বের হলে তার কাছে জিগ্যেস কইরেন।’
প্রতিকার চেয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন আটককৃত বজল করিমের স্ত্রী রাশেদা বেগম। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, স্থানীয় বাসিন্দা ও তার আত্মীয় রসিদ আহমদ ওরফে ধলা মিয়ার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিন ধরে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলছে। ধলা মিয়া এলাকার একজন চিহ্নিত মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। তিনিই তার স্বামীকে ফাঁসিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদকের কর্মকর্তারা চাঁদা দাবির পরে রাশেদা বেগম বিষয়টি বিডি২৪ লাইভের কক্সবাজার প্রতিনিধি ও স্থানীয় দৈনিক মেহেদীর অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকে জানান। রাসেল বিষয়টি নিয়ে অভিযানে থাকা মাদকের কর্মকর্তা তন্তুমনি চাকমার সঙ্গে কথা বলেন। এতে কাজ না হলে রাসেল সহকারী পরিচালক দিদারুলকে ফোন করেন। তিনি ফোন না ধরায় টেক্সট করেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে যান দিদারুল। পরে রাশেদার স্বামীকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়েই ক্ষান্ত হননি। সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকেও মাদক মামলায় ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করেন। এরপর সেদিন রাতেই এক মাদক কারবারীকে ধরে নিয়ে সাংবাদিক ডেকে মিডিয়ার সামনে তাকে দিয়ে বলান সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল মাদক কারবারি। এবং ওই মাদক কারবারির পেটে ১৭ শত ১২ পিস ইয়াবা আছে, যার মালিক সাংবাদিক শাহীন রাসেলের। পরে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে তদন্ত কমিটির প্রধান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক মো: জাহিদ হোসেন মোল্লাকে একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে শাহীন মাহমুদ রাসেল জানান, মাদকদ্রব্য কালসাপ খ্যাত এডি দিদার কক্সবাজার কার্যালয়ে যোগদান করার পর থেকে বহু অপকর্ম করে ফেলেছে। ওই মাদক কার্যালয়ের তন্তুমনি চাকমা, তায়রীফুল ইসলামসহ একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। তারা মাদক নির্মূলের নামে মাদক ব্যবসা, আটক কিংবা গ্রেফতার বাণিজ্য করাই তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে থাকার কারণে জেলার সবকিছু তাদের নখদর্পণে রয়েছে। এ কারণে মাদকের এই কালসাপগুলোর অপরাধের মাত্রা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত টিমের কাছে জবানবন্দি দিতে যাওয়ার পর মঙ্গলবার বিকালে কক্সবাজার জেলার মূলধারার সাংবাদিকদের সামনে তার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান এডি দিদারুল। এছাড়া বিষয়টি সমাধানের জন্য নানা মাধ্যমে তাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেন।
শাহীন মাহমুদ রাসেল বলেন, ‘আমি সত্যের পক্ষে লিখেছিলাম বলেই আমাকে টার্গেট করে মিথ্যা মাদক মামলা দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। এডি দিদারুলের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও আমি শঙ্কিত, কারণ তিনি ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। আমাকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় বিচার পাবো কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।’
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর