
ভয়ংকর সন্ত্রাসের পাখায় ভর করে ছিনতাই ও ভূমিদস্যুতা থেকে শত শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন মিন্টু।
জুলাই বিপ্লবের পর সহিংসতার মামলায় লাপাত্তা মিন্টু সম্পদ লুকাতে স্ত্রীকে সাজিয়েছিল ব্যবসায়ী। ভৈরব থানার কাছে তার প্রাসাদোপম জান্নাত হোটেল ছিল প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন-নির্যাতনের ‘আয়নাঘর’।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন মিন্টু প্রথম জীবনে ছিল ছিঁচকে পকেমার-ছিনতাইকারী। পরে ভূমিদস্যুতা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন রাজনীতির চরকি ব্যবহার করে তার শত শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার কাহিনি যেন ‘আলী বাবা চল্লিশ চোর’ উপাখ্যানকেও হার মানায়।
মিন্টু ১৪ বছরে হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনসহ প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে কৌশলে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
তার ঘনিষ্ঠ একই গ্রামের এক নারী বলেন, মিন্টু সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে যেতেন মন্ত্রী-এমপিদের ভোগবিলাস-মনোরঞ্জনের জন্য। এসব মন্ত্রী-এমপির প্রভাব খাটিয়ে সে অনিয়ম-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, বালু, মাদক ও দখল বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপরাধ-অনিয়মের নিয়ন্ত্রক হয়ে গড়ে তুলেছে টাকার পাহাড়। ভুক্তভোগীরা জানান, মিন্টু ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ভৈরব বাজার রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ছিনতাইকারী ও পকেটমার হিসাবে পরিচিত ছিল।
ভৈরব বাজারের এক বাসিন্দা বলেন, আমি চল্লিশ বছর ধরে ভৈরব বাজারে থাকি। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তার বাপ-চাচারা দুই ভাই রাজা মিয়া ও বাদশা মিয়া। বাদশা মিয়ার ছেলে হলো মিন্টু। মিন্টু ভৈরব বাজারে রেলওয়ে স্টেশনে সারাদিন ঘুরে মদ-গাঁজা সেবন করত। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সে ভৈরব বাজারে রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পকেট মারত, ছিনতাই করত। এসব কাজ করতে গিয়ে সে কয়েকবার ধরাও পড়েছে। আমি তাকে কয়েকবার পকেট মারতে গিয়ে ধরা খেয়ে গণপিটুনির শিকার হতে দেখেছি।
জানা গেছে, ভৈরবের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মো. মনির হোসেনদের পরিবারের ১৩০ শতক জমি মিন্টু জোর করে দখল করেছে। তারা ভৈরব থানায় মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ তখন মামলাও নেয়নি।
শিরিনা বেগম নামে এক নারী বলেন, তার স্বামীর কাছ থেকেও মিন্টু ৩৫ শতক জমি দখল করে রিসোর্ট তৈরি করেছেন। মিন্টুর বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। উলটো তার স্বামীকে জান্নাত হোটেলের আয়নাঘরে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে মিন্টুর সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী।
আরেক ভুক্তভোগী ভৈরবের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, জিল্লুর পুত্র পাপনের দাপট দেখিয়ে মিন্টু মানুষের ওপর জোর-জুলুম, অত্যাচার করত। সে আমার বেলাবর তেলের পাম্প দখল করে নিয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে থানায় মামলা করতে কেন গেলাম এই খবর পাওয়ার পর মিন্টু তার বাহিনী দিয়ে আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। জান্নাত হোটেলের মাটির নিচে একটি অন্ধকার কক্ষে নিয়ে হাত-পা-চোখ বেঁধে আমাকে মারধর করা হয়, জোর করে দলিলে স্বাক্ষরও নেওয়া হয়। রাজু আহাম্মেদ নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, তার ২০০ শতক জমি জোর করে দখল করেছেন মিন্টু। তার কথার বা ইচ্ছার বাইরে যে গেছে তার ওপরই নেমে এসেছে নিষ্ঠুর নির্যাতনের খড়গ।
কেনার আশ্বাস দিয়ে ভৈরব বাজার এলাকার নিলুফা বেগমেরও ৩০ শতক জমি দখল করেছে মিন্টু। উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের কামাল হোসেন, ময়নাল হোসেন ও সফিক মিয়ার কাছ থেকেও ভৈরব বালুমহল এলাকায় প্রায় ৩০০ শতক জমি দখল করছে মিন্টু।
এলাকায় মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ২০০৫ সাল থেকে মিন্টুর উত্থানের পাখা মেলতে শুরু করে। তখন সে কিশোর গ্যাং তৈরি করে। কিশোর গ্যাং দিয়েই সে চুরি-ছিনতাই ও মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগে একজন কর্মী হিসাবে যোগদানের পরই যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যায় মিন্টু।
মিন্টু আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত চার মেয়াদে ভৈরব থেকে কাউন্সিল নির্বাচিত হয়েছে। পৌর কাউন্সিলর হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে মিন্টু নিজে দখল করেছে শত শত একর জমি। গড়ে তুলেছে পর্যটনকেন্দ্রসহ নানা বিলাসী প্রকল্প। দখলের ক্ষেত্রে সে নিজের ভাইদেরও ব্যবহার করেছে। স্ত্রীর নামে নিয়েছে গার্মেন্ট ও হোটেল-রেস্তোরাঁর লাইসেন্স।
২০২৩ সালের মার্চে তার বিরুদ্ধে সদরঘাট কেরানীগঞ্জে একটি ডকইয়ার্ড দখলের অভিযোগ ওঠে। স্ত্রী লাভলী ফাতেমার নামে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অভিনব কৌশলে ব্যাংক ঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় ব্যাংকের ওপর। এর পাশাপাশি সে হয়েছে বালুর ট্রলার-বাল্কহেডের মালিক। এরই মধ্যে এক ডকইয়ার্ড মালিক তার বিরুদ্ধে ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে লিগ্যাল নোটিশও পাঠিয়েছেন। মিন্টু সর্বসাকুল্যে প্রায় ২০০ একর জমি দখল করেছে। এসব জমিতে সে গড়ে তুলেছে মহিষের খামার, পুকুর, বাগান, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মিন্টু অনেক মানুষ মেরে মেঘনা নদীতে ফেলে লাশ গুম করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভৈরব বাজারের এক চা দোকানদার বলেন, সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদারের চেয়েও ভয়ংকর ছিল ছিনতাইকারী-পকেটমার থেকে আওয়ামী লীগের লেবাস নিয়ে রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া মিন্টু। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ কথা বলার সাহস পেত না।
পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরদিন জান্নাত হোটেলে মিন্টুর আয়নাঘর পুড়িয়ে দেয় বৈষম্যবিরোধী বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনত। তখন সেখানে ৩ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আত্মগোপন করে ভৈরবের মূর্তিমান আতঙ্ক মিন্টু এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বাঁধন/সিইচা/সাএ
সর্বশেষ খবর