
সংবাদ প্রকাশের জেরে মাদক মামলায় সাংবাদিককে ফাঁসানোর চেষ্টার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত সময় পার করছে মাদকদ্রব্য কক্সবাজার কার্যালয়ের ‘কালসাপ’ খ্যাত এডি একে এম দিদারুল আলম।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি এই কেলেঙ্কারি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কোটি টাকার মিশন পরিচালনা করছেন, যেখানে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা চলছে।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, দিদার এবং তার সহযোগীরা গণমাধ্যমের নজর এড়াতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি, মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি কক্সবাজার মাদকদ্রব্যের এডি দিদার সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেলকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টা করেন। এ ঘটনা দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ক্ষোভে ফুঁসে উঠে সাংবাদিক সমাজসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ।
এমতাবস্থায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে আরও রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির খন্দকার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় চট্টগ্রাম উত্তরের সহকারী পরিচালক রামেশ্বর দাসসহ তিনজন কর্মকর্তা।
গত মঙ্গলবার (১১ মার্চ) দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হয়। তদন্ত দল অভিযুক্ত এডি দিদারুল, তার টিমের অন্যান্য সদস্য, ভুক্তভোগী সাংবাদিক শাহীন মাহমুদ রাসেল এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষ্যগ্রহণ করে ও লিখিত জবানবন্দি নেয়। একই সঙ্গে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ভিডিও ও অন্যান্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়। যা পরে ওই রাতেই ই-মেইল যোগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিক্তিতে এডি দিদারুল আলমের বিরুদ্ধে সাংবাদিককে ইয়াবা ব্যবসায়ী প্রমাণের চেষ্টার অভিযোগের প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত দল। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। কিন্তু তিনি মাদক থেকে উপার্জিত কোটি টাকা খরচ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্নভাবে প্রচার করছেন টাকা সব মিটমাট করে ফেলেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, মাদকদ্রব্য কালসাপ খ্যাত এডি দিদার কক্সবাজার কার্যালয়ে যোগদান করার পর থেকে বহু অপর্কম করে ফেলেছে। ওই মাদক কার্যালয়ের তন্তুমনি চাকমা, তায়রীফুল ইসলামসহ একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। তারা মাদক নির্মূলের নামে মাদক ব্যবসা, আটক কিংবা গ্রেফতার বাণিজ্য করাই তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে থাকার কারণে জেলার সবকিছু তাদের নখদর্পণে রয়েছে। কারণে মাদকের এই কালসাপগুলোর অপরাধের মাত্রা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত টিমের কাছে জবানবন্দি দিতে যাওয়ার পর মঙ্গলবার বিকালে কক্সবাজার জেলার মূলধারার সাংবাদিকদের সামনে তার কাছে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান এডি দিদারুল। এছাড়া বিষয়টি সমাধানের জন্য নানা মাধ্যমে তাকে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেন।
শাহীন মাহমুদ রাসেল বলেন, ‘আমি সত্যের পক্ষে লিখেছিলাম বলেই আমাকে টার্গেট করে মিথ্যা মাদক মামলা দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। এডি দিদারুলের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও আমি শঙ্কিত, কারণ তিনি ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। আমাকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় বিচার পাবো কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, দিদারের এই কোটি টাকার মিশন শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে সাংবাদিকদের দাবি, মাদক মামলার প্রকৃত সত্য যেন সামনে আসে এবং অপরাধী যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়।
মাদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, তারা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং কোনো ধরনের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা ব্যর্থ হবে।
স্থানীয় সাংবাদিকরা বলেন, মাদক দমন করার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই যদি মাদক ব্যবসা ও গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে, তবে সেটি দেশের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে? সম্প্রতি তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য—মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এডি দিদার নিজেই মাদক ব্যবসা ও গ্রেফতার বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত!
কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে এই অবৈধ সিন্ডিকেট?
বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এডি দিদার কক্সবাজার আসার পর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন। অন্যদিকে, প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের ঘুষ নিয়ে তাদের আড়াল করার অভিযোগও রয়েছে।
এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি টাকা না দিতাম, তাহলে আরও বড় ধরনের বিপদে পড়তে হতো।”
উচ্চপর্যায়ের তদন্তের দাবি:
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সৎ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এডি দিদারের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে, তবে তিনি প্রভাবশালী হওয়ায় এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বিষয়টি আলোচনায় আসার পর উচ্চপর্যায়ের তদন্তের দাবি উঠেছে।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যদি কোনো কর্মকর্তা অপরাধে জড়িত থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
উল্লেখ্য, সোমবার (৯ মার্চ) সকালে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার বাংলাবাজার এলাকার এক সিএনজি চালককে লিংকরোড থেকে ধরে নিয়ে যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের টিম। চালকের স্ত্রীর অনুরোধে মাদক টিমকে ফোন করে তাকে আটকের বিষয়ে জানতে চান বিডি২৪লাইভ ও সময়ের কণ্ঠস্বরের কক্সবাজার প্রতিনিধি এবং স্থানীয় দৈনিক মেহেদীর অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর শাহীন মাহমুদ রাসেল। সাংবাদিক ফোন করায় সিএনজি চালককে ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়া হয়। সন্ধ্যার পর এ বিষয়ে আবারো ফোন করা হলে মাদকের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (এডি) এ কে এম দিদারুল আলম সাংবাদিক শাহীন রাসেলের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান।
এর জের ধরে দু’ঘণ্টার মাথায় পেটে ইয়াবাসহ আটক অন্য যুবকের মাধ্যমে সাংবাদিক রাসেলকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ওই যুবকের নামে করা মাদকের মামলার এজাহারে শাহীন মাহমুদ রাসেলের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করে ফেসবুক টিভিতে বলা কথাই লেখা হয়।
এ ঘটনায় ১০ মার্চ দুপুরে কর্মরত সাংবাদিকরা এডির বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। তাকে ৭২ ঘণ্টার ভেতর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করার দাবি জানান তারা।
এসব বিষয়ে অভিযুক্ত এডি এ কে এম দিদারুল আলমও সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে জনগণ ও মানবাধিকার কর্মীরা জোর দাবি জানিয়েছেন, যেন দ্রুত তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর