
জুলাই গণঅভ্যুত্থান একবারে মাঠপর্যায় থেকে ‘গুছিয়ে নেওয়া’ কিংবা ‘সংগঠিত’ করা কোনো আন্দোলন নয় বলে মন্তব্য করেছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
শনিবার (১৫ মার্চ) নিজের লেখা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের এ উপদেষ্টা বলেছেন, গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
“আমাদের জায়গা থেকে আমরা সর্বোচ্চ যেটা করতে পেরেছি, মানুষের কথাগুলো আমাদের মুখ দিয়ে বলা কিংবা সামনে থেকে সেটাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাওয়া।”
তিনি বলেন, “যখন আমরা ক্যাম্পাসে আক্রমণের শিকার হলাম, তখন থেকেই আমরা আহ্বান জানিয়েছি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের, বিভিন্ন ভিডিও বার্তায় বা মিডিয়ায় বক্তব্য দেওয়ার সময়।
আমরা বুঝতে পারছিলাম, ক্যাম্পাস থেকে আমাদের এক্সাম্পল শুরু হয়ে যাওয়ার পর তারাই আন্দোলনটা জীবিত রাখতে পারবে। আমাদের নিরাপদ সড়ক চাই বা আগের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
“আমরা যে একদম গ্রাউন্ড থেকে গুছিয়ে, একদম সংগঠিত করে রেখেছি, এমন কিছু কিন্তু ছিল না। আমাদের আহ্বানের ফলে খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে এসেছেন, তারা জীবন দিয়েছেন।”
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ বলেন, “সেখানেও কেউ না কেউ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তারা অনেকেই সামনে আসেননি, বা আসার সুযোগ পাননি। এ স্বতঃস্ফূর্ততা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানের দিকে নিয়ে গেছে।”
‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ নামে বইটি লিখেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আসিফ। এটি প্রকাশ করেছে ‘প্রথমা’। শনিবার বিকালে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয় রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে; কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে।
নিজের বই প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, “মাত্র ১২০ পৃষ্ঠায় গণঅভ্যুত্থান তো দূরের কথা, আমার নিজের একান্ত ব্যক্তিগত বা আমার চোখে জুলাই মানুষের সামনে উত্থাপন করাটা সম্ভব নয়। সে জায়গা থেকে এটা একটা ব্রিফ।
“আমি এটা লিখে রাখলাম যেন ভুলে না যাই। আরও সময় পেলে পরবর্তী সংস্করণে হয়ত আরও ডিটেইল লিখতে পারব, আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারব।” বইটির ভূমিকা লেখায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানান আসিফ মাহমুদ।
তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে সময়কার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, আমরা যাদের সহযোগিতা পেয়েছি, পেছন থেকে কারা সহযোগিতা করেছে, তার একটা সাবলীল বর্ণনা আছে।” অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “এসব গল্প প্রত্যেকের জানা থাকা উচিত।”
অভ্যুত্থানে আহতদের গল্প নিয়ে বই প্রকাশ করতে প্রথমা প্রকাশনের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “নাহিদ একটা জিনিস বলেছে, জুলাই অগাস্টের প্রত্যেকের গল্প। আমি আপনাদের কাছে একটা রিকোয়েস্ট করে রাখি, আমাদের যে ছেলেগুলো আহত হয়েছে, তারা ফাইট করে আহত হয়েছে। তাদের গল্পের একটা বই করেন সাজ্জাদ ভাই।“
সজীব ভূঁইয়ার বই লেখার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আসিফ নজরুল বলেন, “সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আমাদের সঙ্গে প্রথমা থেকে যোগাযোগ করা হয়। আমি আসিফকে বললাম, আসিফ তুমি একটা বই লিখ না। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঠিক আছে লিখব।
“আমি বললাম প্রথমার সঙ্গে যোগাযোগ করব? ও বলল করেন। আমি ভেবেছি এমনই বলছে। এত ব্যস্ত থাকে; ওরা ঘুমায় হচ্ছে ফজরের সময় কাজ করতে করতে। প্রায়দিনই, এখনও বোধহয় চোখ লাল আছে।”
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমি বইটার দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছি। আমার কাছে বইটার তিনটা বিশেষত্ব উঠে এসেছে। একটা হচ্ছে আসিফ তো আগে কখনও লিখে নাই। কিন্তু এই বইটার ভাষাটা এতো স্বাচ্ছন্দ্য। নিশ্চয়ই সাজ্জাদ ভাইয়ের অবদান আছে।
“আসিফ যে মনে করতে পেড়েছে ঘটনাগুলো, এতগুলা জিনিস, এতগুলো চরিত্রকে মনে রাখা। একটা ঘটনা বলার তো অনেক স্টাইল আছে। একটা হল গল্পের মত বলা, আরেকটা হচ্ছে বর্ণনা দেওয়া। এ বইটার মধ্যে গল্প আছে, সাহসী বর্ণনা আছে।”
বইটির ‘সীমাবদ্ধতা’ তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, “এ বইয়ে একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, খুবই সংক্ষেপে বলা হয়েছে। স্বাভাবিক, আরও অনেক বড় করে লেখার কথা। যেমন একটা জায়গায় বর্ণনা আছে, আলোচনা হচ্ছে। তারপর একটা দীর্ঘ আলোচনা আছে।
“আমি ছিলাম দেখে মনে আছে জিনিসটা। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেছি, কিন্তু সেটা একটা লাইনে আছে। আসিফ এ বইটা লিখে একটা কাজ করেছে যে ভুলে না যাই। এটা ধরে ধরে আরও বড় লেখা যাবে। আরেকটা হচ্ছে, এ গল্পের কিছু চরিত্রের উল্লেখও নাই। কিন্তু আমি চিনি চরিত্রগুলোকে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা অনেক ভুল করলেও সেটা সঠিক হয়েছে। এটা অবশ্যই এটা মিরাকেল। উপরওয়ালা এখানে সহায়তা না করলে আন্দোলন এভাবে যাইত না।
“মনসুন রেভ্যুলেশন বলা হচ্ছে, কিন্তু আন্দোলনের সময় সেরকম কোনো বৃষ্টিপাত হয় নাই যে মানুষ রাস্তায়ই নামতে পারবে না, এটাও একটা অলৌকিক ব্যাপার বলে আমরা মনে করি। এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনাও ঘটছে। সর্বপরি আমরা সাপোর্ট পাইসি, যাকে চিনি না, জানি না; দলমত নির্বিশেষে আমরা সাপোর্টটা পেয়েছি।”
এ আন্দোলনে ছাত্রলীগের একটা অংশের ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যারা ছাত্রলীগ থেকে বের হয়ে গেছিলেন, যে বিদ্রোহী অংশটা। তারা বের না হাইলে এ আন্দোলনটা পূর্ণতা পেত না।”
তিনি বলেন, “আন্দোলনে ব্লকেড কর্মসূচির ভূমিকা ছিল। আন্দোলনের একটা ব্যাখ্যায় মানুষ বলার চেষ্টা করে, আন্দোলনটা কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়েছিল, পরে যখন হামলা-নিপীড়ন করা হয়, তখন সাধারণ মানুষ নেমে আসে। এটা জেনেরাইজড একটা ব্যাখ্যা।
“ব্লকেড কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঢাকা শহরে গণঅভ্যুত্থানের একটা প্রস্তুতি তৈরি হয়েছিল। আমরা যখন একটার পর একটা ব্যারিকেড ভাঙতেছিলাম; প্রতিদিন একটু একটু করে আগাইতেছিলাম। আমরা কারওয়ান বাজার থেকে ফার্মগেট, মানুষের ভিশনটা কিন্তু বাড়তেছিল, আমরা গণভবন পর্যন্ত যাইতে পারি। ব্যারিকেড ভাঙার যে সাহসটা, ওইটা ব্লকেড কর্মসূচিগুলো থেকে তৈরি হয়েছে।”
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক রিফাত রশিদ উপস্থিত ছিলেন।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর