
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যেখানে প্রতিটি বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। জীবিকার ক্ষেত্রেও ইসলাম হালাল ও হারামের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছে। একজন মুসলমানের জন্য হালাল রুজি অর্জন করা শুধু কর্তব্যই নয়, বরং এটি ইবাদতের অংশ। বিশেষ করে, পবিত্র রমজান মাসে আমাদের আরও বেশি সংযমী হয়ে হালাল উপার্জনের প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। কেননা, হালাল রুজি দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত।
আজ আমরা কোরআন ও হাদিসের আলোকে হালাল রুজির গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الرُّسُلُ كُلُوۡا مِنَ الطَّیِّبٰتِ وَ اعۡمَلُوۡا صَالِحًا ؕ اِنِّیۡ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ عَلِیۡمٌ হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভাল বস্ত্ত থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সর্ম্পকে আমি অবগত।
রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لاَ يَقْبَلُ إِلاَّ طَيِّبًا নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না। (মুসলিম, হাদিস, ১০১৫) অন্য এক হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে ধূলিময় অবস্থায় হাত তুলে দোয়া করল, কিন্তু তার খাদ্য, পানীয়, পোশাক সবই হারাম ছিল, তাই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হবে? (মুসলিম, হাদিস, ১০১৫) এ থেকে বোঝা যায়, হালাল উপার্জন দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত।
নবীজির জীবন থেকে হালাল উপার্জনের উদাহরণ পাওয়া যায়। রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে হালাল উপার্জনে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। নবুয়তের আগেও তিনি ব্যবসা করতেন, সততা ও আমানতের জন্য ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি কখনো সুদ বা প্রতারণার আশ্রয় নেননি। হিজরতের পর মদিনায় তিনি সাহাবিদের কৃষি ও ব্যবসায় উৎসাহিত করেন। তিনি নিজে শ্রমের মূল্যায়ন করে বলেন, কোনো ব্যক্তি নিজের হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো খায়নি। (বুখারি, হাদিস,২০৭২)
সাহাবায়ে কেরামেও ছিলেন হালাল উপার্জনের আদর্শ। হালাল রুজি অর্জনের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন তারা। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্ব ছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যবসায় মনোযোগী হন , হালাল পথে উপার্জন করে অল্প সময়েই ধনী হয়ে ওঠেন। হযরত উমর (রা.) বলতেন,তোমাদের কেউ যেন হালাল উপার্জন ছেড়ে অলস বসে না থাকে, আল্লাহর ওপর ভরসা করার অজুহাতে জীবিকা অন্বেষণ না করে।
আজ আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে আছি, যখন আমাদের অজান্তেই হারাম আমার ঘরে চলে আসছে। সর্বপ্রথম হারাম থেকে বাঁচতে আমাদের সচেতন হতে হবে। এজন্য কিছু করণীয় আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। ১. সুদ ও ঘুষ পরিহার করতে হবে। রসুল (সা.) সুদকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, লেখক, সাক্ষী, সবাই অভিশপ্ত। (মুসলিম, হাদিস,১৫৯৮) ২. পৃথিবীতে সব ধরণের প্রতারণা ও মিথ্যা পরিহার করতে হবে। ব্যবসা বা চাকরির ক্ষেত্রে প্রতারণা করা হারাম। ৩. অন্যের হক নষ্ট না করা, কাজের বেতন বা পাওনা যথাযথভাবে প্রদান করা জরুরি। ৪. হালাল-হারাম যাচাই করা, প্রতিটি আয়ের উৎস ও খাদ্য-পানীয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া উচিত। ৫. তওবা ও দোয়া করা, যদি কখনো ভুলক্রমে হারাম প্রবেশ করে, তবে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা উচিত।
আমরা সবাই জানি। হালাল উপার্জন দোয়া ও ইবাদত কবুল হওয়ার শর্ত। রমজান দোয়ার মাস। আমরা সবাই এ মাসে আল্লাহর কাছে দোয়া করি, ক্ষমা চাই। কিন্তু যদি আমাদের উপার্জন হারাম হয়, তাহলে দোয়া কবুল হবে না। রসুল (সা.) বলেছেন, হারাম খাদ্যে লালিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (তিরমিজি) রমজান সংযমের মাস। শুধু খাবার-পানীয় থেকে বিরত থাকাই সংযম নয়, বরং হারাম আয় থেকে বেঁচে থাকাও সংযমের অংশ। যারা সুদ, ঘুষ, প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন করে, তারা প্রকৃত সংযমের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। রমজান আমাদের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। কিন্তু যদি আমাদের জীবিকা হারামের ওপর ভিত্তি করে হয়, তাহলে রোজার বরকতও কমে যাবে। রমজান মাসে সাহাবায়ে কেরাম দান-সদকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন, কিন্তু তাদের দান সবসময় হালাল উপার্জন থেকেই হতো। রাসূল (সা.) বলেছেন,আল্লাহ পাক শুধু পবিত্র বস্তু গ্রহণ করেন। (মুসলিম) অতএব, যদি আমাদের আয় হারাম হয়, তাহলে দান-সদকা, ইফতার করানো, জাকাত প্রদান, এসবও আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।
যারা সুদ ও ঘুষের সঙ্গে জড়িত, তাদের জন্য রমজান হলো আত্মশুদ্ধির উপযুক্ত সময়। কারণ এ মাসে শয়তান বন্দী থাকে , মানুষের অন্তর নরম থাকে। এই সুযোগে হারাম ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমরা অনেকেই মনে করি হারাম আয় ছাড়া জীবিকা সম্ভব নয়। কিন্তু রমজান আমাদের আত্মসংযম শেখায়। যদি আমরা সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকতে পারি, তবে হারাম থেকেও বেঁচে থাকতে পারি। এই মাসে হালাল উপার্জন ও খরচ করলে আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ হয়। রসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খোলা থাকে।
হালাল উপার্জন শুধু আমাদের দুনিয়ার জন্য নয়, আখিরাতের মুক্তির জন্যও জরুরি। রমজান মাস আমাদের আত্মশুদ্ধির মাস, তাই এ মাসে আমাদের উচিত হালাল জীবিকার প্রতি আরও যত্নবান হওয়া। আসুন, আমরা হারাম থেকে বেঁচে থেকে পবিত্র রিজিক উপার্জনের মাধ্যমে দোয়া কবুলের উপযোগী হই , জান্নাতের পথ সুগম করি।
اللهم ارزقنا رزقا حلالا طيبا وبارك لنا فيه، واجعلنا من عبادك الصالحين (হে আল্লাহ! আমাদের হালাল ও পবিত্র রিজিক দান করুন, এতে বরকত দান করুন। আমাদের সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর