
আকাশজুড়ে সূর্যাস্তের অপরূপ লালচে আভা। সঙ্গে মন ভালো করে দেওয়া সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউ। পেছনে আবার শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো সবুজ সৈকত। সৈকতের বিশাল বালুকাবেলা জুড়ে বসেন সারিবদ্ধ হয়ে।
ঢেউয়ের গর্জন আর হালকা বাতাসের শীতল স্পর্শে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি হয় সমুদ্র সৈকতে। এই মনোরম পরিবেশেই ইফতার আয়োজন করেছে একদল তরুণ-যুবক। এর মাঝখানে বসেই ঢেউ গুনতে গুনতে চলছে দল বেঁধে ইফতার গ্রহণ।
বসন্তের কাঠফাটা রোদে দিনভর রোজা রাখার পর সমুদ্র বা নদী তীরে ইফতার করার এমন দৃশ্য এখন দেখা যাচ্ছে নিয়মিতই। বদ্ধ ঘর ছেড়ে মুক্ত হাওয়ায় ইফতার করার বিষয়টি আজকাল তরুণদের বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। ফেসবুকে ঢুকলেই প্রতিদিন দেখা মিলছে এমন সব মুহূর্তের।
অনেক পর্যটক কেবল এই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার অংশ হতে বিশেষভাবে কক্সবাজারে আসেন। আলী আকরাম শুভ নামের একজন পর্যটক বলেন, সমুদ্র সৈকতে এমন ইফতার আয়োজন সত্যিই অসাধারণ। ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে ইফতার করার অনুভূতি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
সমুদ্র আর নদী তীরে ইফতারে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে কথা হয় পতিবেদকের। তারা বলেন, নানা কারণে সবার মনের ওপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় তারা সেটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। দিনভর রোজা রাখার পর হোটেল–রেস্তোরাঁর দমবন্ধ পরিবেশে ইফতারে মন আরও খিটখিটে হতে পারে। সে জন্য তারা ইফতারসামগ্রী নিয়ে ছুটছেন সমুদ্রতীরে।
এসএসসি ২০১৩ ও এইচএসসি ২০১৫ সালের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপের উদ্যোগে কক্সবাজারের বন্ধুরা মিলে ইফতার করেছেন সুগন্ধা পয়েন্টের সমুদ্র সৈকতে। এই ইফতারে অংশ নেন অন্তত ২০ জন। হোটেল থেকে ইফতারসামগ্রী কিনে মোটরসাইকেলে চড়ে তারা যান শহরের অদূরের সেই সৈকতে। এরপর সৈকতে ত্রিপল বিছিয়ে সবাই বসে সারেন ইফতার। একদিকে যেমন হলো ভ্রমণ, তেমনি হলো ইফতার আয়োজনও।
এই আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা রাফাত রহিমের কাছে সমুদ্রসৈকতে এমন উদ্যোগের কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘সমুদ্র সৈকতের পরিবেশটাই অন্যরকম। এখানে শীতল বাতাস, ঢেউ, গর্জন মিলে অন্যরকম এক আবহই তৈরি হয়। দিনভরের রোজার ক্লান্তি শেষে সেই পরিবেশে ইফতার করলে মন–শরীর দুটোই ভালো হয়ে যায়। সে জন্যই মূলত বন্ধুদের নিয়ে এখানে ইফতার করতে আসা।’ এই আয়োজনে বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ।
তবে সমুদ্রের তীরে ইফতার আয়োজনে পিছিয়ে নেই তরুণীরাও। স্কুটি চালানো শিখতে শিখতে বন্ধু হয়ে পড়া তরুণীদের ‘পঙ্খীরাজ’ নামের একটি পেজ আছে ফেসবুকে। সেই পেজের উদ্যোগেও আয়োজন করা হয়েছে এমন ভিন্নরকম ইফতার আয়োজন। তবে তরুণীরা বঙ্গোপসাগরের বালিয়াড়িতে নয়, ইফতার আয়োজন করেছেন কবিতা চত্বরে।
তরুণীদের এই আয়োজনে আরও একটা ভিন্নতা ছিল। সেটি হলো ইফতার সামগ্রী তারা কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে কিনে নিয়ে যাননি। ঘর থেকে কেউ বানিয়ে নিয়েছেন বিরিয়ানি, কেউবা পিঠা, সমুচা, শিঙারা। আবার কেউবা ছোলা-শরবত।
পঙ্খীরাজের স্বপ্নদ্রষ্টা এনজিওতে কর্মরত কামরুন নাহার পিঙ্কী বলেন, ‘আমরা বরাবরই প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে চাই। রেস্তোরাঁর বদ্ধ জায়গায় সেটি সম্ভব নয়। সে জন্যই আমরা সৈকতের পাড়ের ঝাউবাগানে খোলা পরিবেশে ইফতার আয়োজন করেছি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী রবি হোসাইনও এই রমজানে অনেকবার বন্ধুদের নিয়ে ইফতার সেরেছেন সৈকতে লাবণী পয়েন্টে। সৈকতে ইফতারের পেছনে অন্যরকম এক ভালো লাগা খুঁজে পেয়েছেন এই তরুণ। তার ভাষায়, ‘রোজার দিনে এমনিতেই স্নিগ্ধতা কাজ করে সবকিছুর প্রতি। ইফতারের আগে সমুদ্রতীরে সূর্যাস্তের আগে যে রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ে সেটা দেখে খুব ভালো লাগে। এরপর আজানের সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত প্রকৃতি বদলাতে থাকে। এটা দেখতে দেখতে ইফতার সারার সময় সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করে। এ জন্যই মূলত সমুদ্রতীরে ইফতার করা।’
সমুদ্রের বুকে বন্ধুত্বের মিলনমেলা:
এ আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা রাফি বলেন, “প্রতিদিন বাসা বা রেস্তোরাঁয় ইফতার করি, কিন্তু সৈকতের বুকে প্রকৃতির মাঝে ইফতারের মজাই আলাদা। তাই আমরা সবাই মিলে এমন কিছু করার পরিকল্পনা করি।”
আরেকজন অংশগ্রহণকারী নাঈম জানালেন, “সৈকতের বাতাস, ঢেউয়ের শব্দ আর আকাশের খোলা পরিবেশে বসে ইফতার করার অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ। এটা আমাদের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
ইফতার শেষে দোয়া ও আড্ডা:
সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ উঁকি দেওয়ার সাথে সাথে ইফতার শেষে সবাই একসঙ্গে দোয়া করে। এর পরেই শুরু হয় প্রাণবন্ত আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা আর গল্পের ঝড়। অনেকে সৈকতে হাঁটতে বের হয়, কেউবা ক্যামেরা হাতে ধরে রাখে এই বিশেষ মুহূর্তগুলো।
ভিন্নধর্মী আয়োজনের প্রশংসা:
স্থানীয় অনেক দর্শনার্থীও এ আয়োজন দেখে মুগ্ধ হন। সৈকতে ঘুরতে আসা এক পর্যটক বলেন, “তরুণদের এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি ইফতার আয়োজনের নতুন ধারা হতে পারে।”
সমাপ্তি, কিন্তু স্মৃতি চিরস্থায়ী:
অবশেষে রাত নামলে সবাই ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করে। তবে এই ইফতার শুধু একদিনের আয়োজন নয়, এটি হয়ে থাকবে এক আনন্দঘন স্মৃতি, যা তরুণদের বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন আরও দৃঢ় করবে।
সমুদ্রের গর্জন তখনও শোনা যাচ্ছে, ঢেউ এসে ধুয়ে দিচ্ছে বালুর চিহ্ন, কিন্তু তরুণদের হৃদয়ে রয়ে যাবে নীল ঢেউয়ের সান্নিধ্যে কাটানো এক স্মরণীয় ইফতারের গল্প।
প্রতিবছরের মতো এবারও রমজানের বিশেষ আয়োজন হিসেবে সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটক ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা অংশগ্রহণ করেন।
কক্সবাজার সৈকতে হাজার হাজার মানুষের একসাথে ইফতার শুধু একটি ধর্মীয় আয়োজন নয়, বরং এটি ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। প্রতিবছর এ আয়োজন আরও বড় পরিসরে হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর