
কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ ৫২০ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছেন এনামুল হক নামের এক যুবক। মামলায় মৃত দুই আওয়ামী লীগ নেতা—জাফর আলম মাঝি ও জামাল হোসেনকে আসামি করার ঘটনায় বিস্ময় ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা যুবক, রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকা ব্যক্তি এমনকি একই ব্যক্তিকে তিন থেকে দু’বার আসামি করার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে জেলাজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অনেকেই এই মামলাকে ‘নাটকীয়’ ও ‘বিতর্কিত’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। নেটিজেনদের মধ্যে বিষয়টি হাস্যরসের খোরাক হয়ে উঠেছে, যেখানে অনেকে ব্যঙ্গাত্মক স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
তবে মামলায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না কীসের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এমন দাবিও করছেন কেউ কেউ। শুক্রবার (২১ মার্চ) রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি দাবি করে ওই যুবক বাদি হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের ছাদেক ফকির পাড়ার নবী হোসেনের ছেলে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নে থাকেন।
এদিকে জেলার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। এমনকি অনেকে কসম করেও বলেছেন যে, তারা মামলাটির ব্যাপারে আগে কোনো ধারণাই পাননি।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া আ.লীগ নেতা জাফর আলম মাঝিকে মামলার আসামি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জামিল হোসাইন, যিনি চলতি বছরের ১৬ মার্চ মারা গেছেন, তাকেও ৩৯৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের নাম আসামি তালিকায় থাকায় এ মামলার নির্ভুলতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
এছাড়াও ৩০০, ৩০৭ ও ৩১৫ নম্বরে ফারুক নামের টেকনাফের এক যুবককে তিনবার আসামি করা হয়েছে। তাকে এক জায়গায় সাবেক এমপি বদির বোন জামাই, অন্যটিতে টেকনাফ উপজেলা আ.লীগের সহ-সভাপতি ও টেকনাফ ডিগ্রি কলেজের সহ-সভাপতি উল্লেখ করা হয়েছে। ১৭২, ৪৬৩ নম্বরে দুইবার ঈদগাঁও উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আসামি ইমরুল হাসান রাশেদকে আসামি করা হয়েছে।
এছাড়াও আড়াই বছর ধরে দুবাইতে থাকা প্রবাসী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আয়ুব আলীকে ৪২৭ নম্বরে আসামি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ৪ জনকে দুইবার করে আসামি করা হয়েছে। যা মামলার তথ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের গাফিলতির প্রমাণ বহন করে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অনিয়ম মামলার গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং নিরপরাধ ব্যক্তির হয়রানির আশঙ্কা তৈরি করে।
আ.লীগ নেতা মৃত জাফর আলমের ছেলে সাইফুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “আমার বাবা জাফর আলম ঈদগাঁওয়ের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগছিলেন এবং ২০২৩ সালের ৬ জুন তার অপারেশন হয়। এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে তিনি মারা যান। অথচ তার নাম মামলার আসামির তালিকায় দেখে আমরা হতবাক।”
অভিযোগ আছে, মামলার এজাহারের কপি ১৫ থেকে ২০ দিন আগেই আসামিদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বলে জানা গেছে। সাধারণত মামলা দায়েরের পর আসামিদের নাম ঠিকানা প্রকাশ হয়, কিন্তু এতদিন আগেই মামলার কপি পৌঁছে যাওয়ার ঘটনায় অনেকে অভিযোগ তুলেছেন—এটি কি পূর্বপরিকল্পিত। তাদের মতে, মামলার আগেই কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে যোগাযোগ করে টাকা চাওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে কিছু ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া ও টাকা পেয়ে নাম যোগ করা হয়েছে। এতে করে মামলার স্বচ্ছতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাপক সংশয় তৈরি হয়েছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জিনিয়া শারমিন রিয়া তার পেইসবুকে পোস্টে লিখেছেন, ‘কক্সবাজার জেলার ব্যানারে কক্সবাজার সদর থানায় ইতিমধ্যে ৫২০ জনকে আসামি করে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে- আমি জিনিয়া এই মামলা সম্পর্কে মোটেও অবগত নয় সুতরাং মামলার এজাহারে কোন নিরপরাধ ব্যক্তির নাম এসেছে বা কোন মৃত ব্যক্তির নাম এসেছে সে ব্যাপারে বিরক্ত না করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’
৫২০ জনের মামলা নিয়ে ছাত্র প্রতিনিধি সাহেদ লিখেছে,‘আল্লাহর নামে কসম করে বলতেছি আমি এই মামলা সম্পর্কে অবগত না।’
আরেক প্রতিনিধি রিয়াদ মনি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনাও এইভাবে মৃত মানুষকে মামলা দিত।কলঙ্কের দাগ লাগতেছে জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে– কারা মামলাবাজ, চাঁদাবাজ ও টেন্ডারবাজ জাতির কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াস খান বলেন, “এমন কিছু হয়ে থাকলে তদন্ত করে মৃত ব্যক্তির নাম বাদ দেওয়া হবে।” তবে মামলায় এত এত ভুল কেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, গত ৪ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত কক্সবাজার শহরের লালদিঘীর পাড়, শহীদ মিনার, গুমগাছ তলা, হকশন ও আশেপাশের সড়কে জনমনে আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি, হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা, বিস্ফোরণ উপকরণ ব্যবহারসহ নানা অপরাধসহ নানা অপরাধ মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেখানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সিরাজুল মোস্তফা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, আশেক উল্লাহ রফিক, জাফর আলম, আবদুর রহমান বদি, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র মাহবুবুর রহমার চৌধুরী, জেলা পরিষদরে সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাফ আহমদ চৌধুরী, শাহীনুল হক মার্শাল, কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি নজিবুল ইসলামসহ ৫২০ নামের নাম উল্লেখ রয়েছে। অজ্ঞাত দেখানো হয়েছে আরও ২৫০ জনকে।
মামলা নাম উল্লেখ থাকা সকলেই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যবু মহিলা লীগ, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও বিভিন্ন ওয়ার্ডের দায়িত্বশীল।
আসামির তালিকায় রয়েছেন জেলা জাসদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন মাসুর নামও। এ নিয়ে ৫ আগস্ট পরবর্তী কক্সবাজার জেলার ৯ উপজেলায় ২২টি মামলা দায়ের করা হল।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর