
কক্সবাজারের উখিয়ার থ্যাংখালীতে প্রশাসনের নাকের ডগায় জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠছে একটি অবৈধ বাজার। ১৯নং পুলিশ ক্যাম্পের দেয়াল ঘেঁষে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে চলছে পরিবেশ ধ্বংসের মহোৎসব। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপিপন্থি একটি চক্রের ছত্রছায়ায় এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। প্রথমে পাহাড় কেটে মাটি এনে জলাশয় ভরাটের কাজ শুরু হলেও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কিছুদিন তা বন্ধ ছিল। কিন্তু পরে নতুন কৌশলে বীরদর্পে সড়কের পাশের খাল থেকে অবৈধভাবে বালু এনে জায়গা ভরাট শুরু হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৯ নম্বর পুলিশ ক্যাম্পের দেয়াল ঘেঁষে নিয়মিত মিনি ট্রাকযোগে বালু ফেলা হচ্ছে। ওই স্থানের কয়েকশ ফুট দক্ষিণে, সড়কের পাশে তিনটি ড্রেজার বসিয়ে প্রকাশ্যে বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজারের বিকট শব্দে চারপাশের পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে, আর বালু বহনকারী ভারী যানবাহনের লাগাতার চলাচলে পুরো এলাকা ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। নিয়মবহির্ভূত এই কার্যক্রম শুধু পরিবেশের জন্য হুমকি নয়, বরং আশপাশের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে জলাশয় ধ্বংস ও অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে এ এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশগত দুর্যোগ সৃষ্টি হতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্লিপ্ততা এবং অসাধু কর্মকর্তাদের মদতে দিনের পর দিন এই পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলছে। জলাশয় ভরাটের এই পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, কিছু অসাধু কর্মকর্তার মদতে এই অনিয়ম অব্যাহত রয়েছে, যা ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ও বন্যার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনই স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এই অপরিকল্পিত ভরাট এলাকার মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
নায়কোচিত ভঙ্গিতে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী জয়নাল মেম্বার:
থ্যাংখালীর এই অবৈধ বাজার নির্মাণের পেছনে মূল নেতৃত্বে রয়েছেন কুখ্যাত সন্ত্রাসী জয়নাল মেম্বার। অস্ত্র ব্যবসা, মাদক চোরাচালান, নারী কেলেঙ্কারিসহ দুই ডজন ফৌজদারি মামলার আসামি এই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছেন। মাদক অস্ত্রসহ বহু অপকর্মের দায়ে একাধিকবার কারাগারে গেলেও তার অপতৎপরতা থেমে নেই, বরং আরও বেড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, জয়নাল মেম্বার ও তার অনুসারীরা রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের জোরপূর্বক এই অবৈধ বাজারে দোকান বসাতে বাধ্য করছে। কেউ তার নির্দেশ না মানলে তাদের ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হচ্ছে।
ভুক্তভোগী রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, ‘আমরা যেখানে ব্যবসা করছি, সেখানে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের নতুন এই বাজারে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। যারা রাজি হচ্ছে না, তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, জয়নাল মেম্বার তার অবৈধ বাজারকে জমজমাট করতে সাধারণ রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের ওপর এক ধরনের দমননীতি চালাচ্ছেন। এতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও জয়নাল সিন্ডিকেটের মধ্যে যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, জয়নাল মেম্বার ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্যের জমি কৌশলে দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বা কাগজপত্রের কারসাজির মাধ্যমে জমির মালিকদের কাছ থেকে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ থ্যাংখালীর আশপাশেই বাজার থাকলেও তিনি পুলিশ ক্যাম্পের পাশে অবৈধ বাজার স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে।
এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রভাব ও অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় জয়নাল মেম্বার এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
তার বিরুদ্ধে ২৪ টি মামলা রয়েছে বলে স্বীকার করে অভিযুক্ত জয়নাল মেম্বার দাবি করেছেন, থ্যাংখালীতে গড়ে ওঠা এই বাজারের মূল মালিক রামিম নামের একজন ব্যক্তি। নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি দাম্ভিকতার সঙ্গে বলেন, ‘আমি এখানে শুধু দেখভালের দায়িত্বে রয়েছি।’
কী ধরনের দায়িত্ব পালন করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘আমি মাটি ভরাট ও নির্মাণ কাজের কন্ট্রাক নিয়েছি। এছাড়াও আমার নিজস্ব আরেকটি বাজারসহ ৪ শতাধিক রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি রয়েছে।’ তিনি আরও দাবি করেন যে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাকে মাটি কাটার অনুমতি দিয়েছেন। তবে, ক্যাম্প এলাকায় যেকোনো ধরনের অপকর্ম বা তার বিরুদ্ধে ওঠা অন্তহীন অভিযোগের বিষয়টি তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন—‘এটি শুধুমাত্র অন্যের জমি হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা। জমি দখলের পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে পুরো এলাকাকে বিপদের মুখে ফেলা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে বাজার থাকার পরও পুলিশ ক্যাম্পের লাগোয়া নতুন বাজার বসানোর উদ্দেশ্য ভালো নয়। প্রশাসন এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এটি আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।’
পরিবেশ ধ্বংস করে এই অবৈধ বাজারের জমি ভরাটে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা কি; জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার অঞ্চলের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
৮-এপিবিএনের অতিরিক্ত ডিআইজি ফজলে রাব্বি বলেন— ‘এই বাজার কিংবা ক্যাম্পের সার্বিক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সিআইসির। পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম বন্ধে উপজেলা প্রশাসন ও সিআইসি অভিযান চালালে আমরা তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন— ‘অবৈধ বাজার বসানোর বিষয়টি শোনার পর আমি সংশ্লিষ্ট সিআইসিকে রিপোর্ট দিতে বলেছি। উপজেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। জেলা প্রশাসককেও বিষয়টি জানানোর পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।’
বিষয়টি খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন।
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছে, এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে থ্যাংখালীতে সন্ত্রাস, মাদক ও অবৈধ দখলের সংস্কৃতি আরও গভীর হবে। প্রশাসনের নীরবতায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যা ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাবে। তাই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই অবৈধ বাজার নির্মাণ বন্ধ করে দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর