
‘কইলানো আজকে ঈদের বাজারে নতুন কাপড় কিনবা’ আমরাদের তইয়া তাইন নতুন কাপড় পইড়া যাইনগি দেখি’—এই বলে কাঁদতে কাঁদতে মুর্ছা যাচ্ছিলেন নিহত কাইয়ূমের স্ত্রী শেখ মিনা বেগম।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার সদরঘাট গ্রামে ঈদগাহে ঈদের জামাত পড়া নিয়ে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে শেখ আব্দুল কাইয়ূম (৫০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হবিগঞ্জ মর্গে পাঠালে ময়নাতদন্ত শেষে বিকাল ৪টায় লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এ সময় নিহত ব্যক্তির বাড়িতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তার আত্মীয়-স্বজনদের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, সৃষ্টি হয় শোকাহত পরিবেশ। পরে লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শুক্রবার রাত ১০টার দিকে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট গ্রামের পশ্চিম পাড়া জামে মসজিদের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শেখ আব্দুল কাইয়ূম (৫০) নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার সদরঘাট গ্রামের দক্ষিণপাড়া ও পশ্চিম পাড়ার অধিকাংশ লোকজন প্রতি বছর সদরঘাট দক্ষিণপাড়া এলাকায় অবস্থিত সৈয়দ আলী ঈদগাহে ঈদের জামাত আদায় করেন। সম্প্রতি সৈয়দ আলী ঈদগাহের ওয়াকফ কাগজ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় পশ্চিমপাড়ার লোকজনের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
শুক্রবার রাতে তারাবির নামাজের পর ঈদগাহে পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাত পড়া সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করতে সদরঘাট গ্রামের দক্ষিণপাড়া ও পশ্চিম পাড়ার মুরুব্বিরা সদরঘাট গ্রামের পশ্চিম পাড়া জামে মসজিদে জড়ো হন।
এ সময় নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট দক্ষিণপাড়া জামে মসজিদে কথা কাটাকাটি হয় একই গ্রামের মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে আব্দুল কাইয়ূম (৫৫) ও কাজী সুন্দর আলীর ছেলে কাজী মুজাহিদ আলী (৩৫)-এর মধ্যে।
আলোচনা শেষে মুরুব্বিরা মসজিদ থেকে বের হয়ে আসার সময় মসজিদের সামনে ওই গ্রামের কাজী সুন্দর আলীর ছেলে কাজী মুজাহিদ মিয়া সদরঘাট দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত শেখ আব্দুল মজিদের ছেলে শেখ আব্দুল কাইয়ূমকে ছুরিকাঘাত করেন।
ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন আব্দুল কাইয়ূম। তাকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আব্দুল কাইয়ূমের মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। খবর পেয়ে নবীগঞ্জ থানার ওসি মো. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নবীগঞ্জ থানা পুলিশ ও গোপলার বাজার তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।
নিহত শেখ আব্দুল কাইয়ূমের স্ত্রী শেখ মিনা বেগম বলেন, তার স্বামী ইফতারের পর মসজিদে নামাজ পড়তে যান। তিনি বলেছিলেন, আগামীকাল (শনিবার) ঈদের বাজার করবেন, ছেলে-মেয়েদের জন্য নতুন পোশাক আনবেন।
"রাতে হঠাৎ খবর আসে, পাশের বাড়ির লোকজন মারপিট করছে, আমি জানি না। ‘আমি কারে নিয়ে ঈদ করমু, কে আমার পুয়াপুরিরের (ছেলে-মেয়ে) ঈদের কাপড় আইন্না দিবু, আর কে পালবু আমারে’ ‘কইলানো আজকে ঈদের বাজারে নতুন কাপড় কিনবা’ কে আমরাদের কাপড় কিনিয়া দিবু ‘এখন আমরাদের তইয়া তাইন নতুন কাপড় পইড়া যাইনগি দেখি’—এই বলে মুর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি।
নিহত শেখ কাইয়ূমের ১ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। ছেলে: শেখ নাঈম (১৮), মেয়ে: শেখ সাথী বেগম (১৫) ও শেখ জ্যোতি বেগম (৮), তারা বাবাকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেছে।
নিহতের মেয়ে শেখ সাথী বেগম বলেন, "আমার বাবা আজ চলে গেছেন। তাকে নিয়ে ঈদ করতে পারবো না, নতুন কাপড় পড়তে পারবো না। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই। তারা সবার সামনে আমার বাবাকে হত্যা করেছে।"
নিহত কাইয়ূমের বড় ভাতিজা শেখ তারেক আহমদ বলেন, "আমরা লাশ দাফনের পর পারিবারিক পরামর্শ করে রাতে থানায় মামলা করবো। এখনো মামলা করা হয়নি।"
এ বিষয়ে কাজী সুন্দর আলীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমি মসজিদে ইতিকাফে ছিলাম। আমার ছেলের সঙ্গে রাস্তায় কাইয়ূম ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হয়। সে কেন এমন করলো, আমি জানি না। আমি ইতিকাফ রেখে পালিয়ে এসেছি।"
দেবপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ রিয়াজ নাদির সুমন বলেন, "ঈদগাহের বিরোধ ও ঈদের জামাত পড়াকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে আব্দুল কাইয়ূম নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি এলাকার একজন নামাজি ও আমলদার মানুষ ছিলেন।"
এ প্রসঙ্গে নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল হোসেন বলেন, "সদরঘাট গ্রামে ঈদের জামাত পড়া নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও মামলার এজাহার নবীগঞ্জ থানায় দেওয়া হয়নি। বাদীপক্ষ বলেছেন রাতে এজাহার দেবেন। আমরা সন্দেহভাজন আসামিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি, তবে এখনও তাদের পাইনি। গ্রামের পরিবেশ শান্ত রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।"
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর