
সুরুজ আলী ও নুরুল ইসলাম জানালেন, পাকিস্তান আমল থেকে শোলাকিয়া ঈদগাহে ঈদের নামাজ আদায় করতে আসেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়। সেই যে পাকিস্তান আমল থেকে শুরু, আজ অবধি প্রতি ঈদেই তাঁরা এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন।
পরক্ষণেই দেখা হয় মাওলানা মো. ইব্রাহিমের (৪০) সঙ্গে। তিনি বাগেরহাট থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে কিশোরগঞ্জ চলে এসেছেন। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে এসেছি।
আজ সোমবার পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকেও কিশোরগঞ্জের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। এ সময় কথা হয় চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে আসা মো. মফিজুর রহমান চৌধুরীর (৫০) সঙ্গে। তিনি মোজাম্বিকপ্রবাসী। মফিজুর রহমান বলেন, ‘এশিয়ার বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠে এলাম ঈদের নামাজ পড়ার জন্য।
আলহামদুলিল্লাহ, বিশাল আয়োজন দেখে অনেক ভালো লাগছে। এখানকার পরিবেশ অনেক সুন্দর। জীবনে প্রথমবার এলাম। আমি মোজাম্বিকে থাকি প্রায় ১৮ বছর। সেখানেই আমার পরিবার থাকে। মোজাম্বিকে এখন পরিস্থিতি ভালো না। সবার কাছে দোয়া চাইছি, যেন মোজাম্বিকের পরিস্থিতি ভালো হয়। এ ছাড়া আমার মতো যাঁরা প্রবাসে আছেন, তাঁরা যেন নিরাপদে থাকতে পারেন, সেই দোয়া চাই।’
ঈদের নামাজ আদায় করতে কক্সবাজার দক্ষিণ রোমালিয়াছড়ার আমিনুল ইসলাম (৪৭) এসেছেন তাঁর বিয়াই রফিকুল ইসলামকে (৪৩) সঙ্গে নিয়ে। তিনি বলেন, ‘গত এক বছর যাবৎ পরিকল্পনা করছি শোলাকিয়ায় এসে ঈদের নামাজ আদায় করব। জামাতটি অনেক বড় হয়। বড় জামাতে নামাজ পড়ার জন্য এক বছর ধরে পরিকল্পনা করছিলাম। খুব কষ্ট করে এসেছি। চার-পাঁচটা গাড়ি বদলে এসেছি। আল্লাহ যেন আমার নামাজ কবুল করেন।’
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কথা হয় কুমিল্লা থেকে আসা মো. মীর হোসেনের (৬৩) সঙ্গে। তিনি এর আগে আরও দুবার শোলাকিয়া ঈদগাহে এসে নামাজ আদায় করেছেন। মীর হোসেন বলেন, ‘এক মাস সিয়াম সাধনার পর আমি এখানে এসেছি।’
জামাত শুরুর আগে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত দেশ-বিদেশ থেকে আগত মুসল্লিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। গত এক মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। দেশবাসীর জন্য দোয়া করার আহ্বান জানানো হয়। সমাগত মুসল্লিদের উদ্দেশে শান্তিপূর্ণ ঈদ জামাত আয়োজনে সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। সেই সঙ্গে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান।
জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল বলেন, ‘শেখ হাসিনার আমলে এই ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কোনো উন্নয়ন হয়নি। তারা লুটপাট নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের দিকে তারা তাকিয়েও দেখেনি। বিএনপি সরকার গঠন করলে এই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠকে আধুনিকায়ন করা হবে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত মুসল্লিরা যেন মাঠ দেখে বুঝতে পারেন এটি ঐতিহাসিক মাঠ।’
কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক মো. রমজান আলী বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমামকেও পরিবর্তন করা হয়েছিল। যাকে (ফরিদ উদ্দিন মাসুদ) এই ঐতিহাসিক ঈদগাহ ময়দানে ইমামতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনি একজন বিতর্কিত আলেম। এ কারণে অনেক মুসল্লি শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশ নিতেন না। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে এবার সর্বোচ্চ মুসল্লি শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে অংশ নিচ্ছেন।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিশোরগঞ্জের সদস্যসচিব ফয়সাল প্রিন্স বলেন, ‘শোলাকিয়া ঈদগাহ আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। এই মাঠকেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার লোকেরা ছাড়েনি। মাঠের ইমাম পর্যন্ত তারা পরিবর্তন করে ফেলে। এবার মাঠে রেকর্ড পরিমাণ লোক ঈদের নামাজ আদায় করতে এসেছেন। সবাই নির্ভয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। কিশোরগঞ্জবাসীসহ দেশবাসীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিশোরগঞ্জের পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছাও জানাই।,
কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মিজাবে রহমত বলেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, লাখ লাখ মুসল্লি ঈদের জামাতে অংশ নিতে এসেছেন। তাঁদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যাপ্তসংখ্যক সেনাবাহিনীর সদস্য, র্যাব সদস্য ও পাঁচ প্লাটুন বিজিবি সদস্য এবং এপিবিএন মোতায়েন ছিল। এ ছাড়া আনসার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। ছিল ফায়ার সার্ভিসেরও বেশ কয়েকটি ইউনিট। দায়িত্ব পালন করেছেন ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। গোয়েন্দা নজরদারি ছিল। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ঈদের জামাত আদায় করেছি।’
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে মুসল্লিদের জন্য পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুসল্লিদের নিরাপত্তায় ছিলেন ১ হাজার ১০০ পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে পোশাকে, সাদা পোশাকে ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অফিসার ফোর্স মোতায়েন ছিলেন। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সম্মানিত মুসল্লিরা ঈদের জামাতে অংশ নেন।’
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মুকিত সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. মাহমুদুল ইসলাম তালুদকদার, র্যাব-১৪ সিপিসি-২ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার মো. আশরাফুল কবির, শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. এরশাদ মিয়া ও কিশোরগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর