
কক্সবাজারের রামু উপজেলার চাকমারকুল ইউনিয়নের ফুঁয়ারচর এলাকা যেন এখন ফসলি জমি ধ্বংসের খোলা ময়দান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাঁকখালী নদীর দুই পাড়ে ছড়িয়ে থাকা শস্য-শ্যামল জমিগুলো আজ হুমকির মুখে।
স্থানীয় জিয়াবুল সওদাগরের ও পুত্র জামশেদ বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে কেটে নিচ্ছেন কৃষিজমি ও নদীর পাড়ের উর্বর মাটি। প্রশাসনের চোখের সামনে, আইনের তোয়াক্কা না করে—এই ভূমিদস্যুদের কার্যকলাপে নাভিশ্বাস উঠেছে এলাকাবাসীর।
তাদের অভিযোগ, সারাদিন ট্রাক আর ডাম্পার চলাচলে ধুলোর ঝড় উঠে। ফসল হয় না, বাড়ি-ঘরের রং বদলে গেছে। এলাকার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, অথচ কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কলঘর বাজার সংলগ্ন ফুঁয়ারচর এলাকায় স্কেবেটর দিয়ে গভীরভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে ফসলি জমি। অদূরেই মাটি বহনকারী ডাম্পার-ট্রাকের দীর্ঘ সারি। কৃষকরা যেখানে ধান, বেগুন, মরিচ, মুলা ও শাকসবজি চাষ করতেন, সেই জমিগুলো এখন বিশাল গর্তে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ৮ থেকে ১০ বছর ধরে জামশেদ ও তার পরিবারের নেতৃত্বে চলে আসছে এই মাটিকাটার অবাধ ব্যবসা। কৌশলে নামমাত্র টাকায় জমির মালিকদের বশে এনে এবং অনেক ক্ষেত্রে জোরপূর্বক মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটা ও নির্মাণ প্রকল্পে। প্রতিবাদ করলে কৃষকদের ওপর চালানো হয় হামলা ও ভয়ভীতি। একাধিকবার অভিযোগ করেও মিলছে না কোনো প্রতিকার।
পরিবেশবাদীদের মতে, নদীর পাড়ে, ফসলি জমির বুকে যে ভূমিদস্যুদের নির্মম খেলা চলছে, তা যেন এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের গল্প। প্রতিদিনই স্কেবেটর, ডাম্পার আর ট্রাকের একে একে গর্জনে কেঁপে ওঠে প্রকৃতি। নদী ও ফসলি জমি যে এক সময় ছিল জীবনের উৎস, তা আজ ধ্বংসের মুখে। অদূর ভবিষ্যতে যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তবে কৃষকরা হারিয়ে ফেলবে তাদের অস্তিত্ব, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং জমির উর্বরতা চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। এই ভূমিদস্যুরা শুধু প্রকৃতিরই নয়, বরং মানুষের ভবিষ্যতকেও হুমকির মুখে ফেলছে। প্রশাসনের অপ্রতুল পদক্ষেপে এই ভয়াবহতা আরও বেড়ে চলছে, আর কিছুদিন পরেই নদী, জমি আর পরিবেশ একাকার হয়ে গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এটা আর কোনোভাবেই থামানো না গেলে, এক সময় এর ক্ষতির সমুচিত মূল্য দিতে হবে।
বৃদ্ধ চাষি আবদুল কুদ্দুস কাঁপা গলায় বলেন,
“তিন পুরুষ ধরে এই জমিতে চাষ করি। এখন সেখানে বিশাল গর্ত। আমি ধান ফলাবো না মাটি বিক্রি করবো?”
একজন নারী কৃষক ফাতেমা বেগম বলেন,“ডাম্পারের ধুলোতে আমাদের ফসল শেষ। সন্তানদের স্কুলের জামা ধুয়ে শুকাতে দেই, ঘণ্টা না যেতেই কাদা-মাটি লেগে যায়। তবু কেউ শোনে না।”
আরও বিস্ফোরক অভিযোগ করে স্থানীয় যুবক সোলাইমান বলেন, “প্রশাসনের কেউ না জানে—এটা কীভাবে সম্ভব? মাঝে মাঝে নাটক করে কিছু গাড়ি জব্দ করে। দুই দিন পর আবার সেই আগের মত মাটি কাটা শুরু হয়। এটা চুক্তির খেলা।”
নদীর পাড়ে বসবাসকারী নুরুল আমিন (ছদ্মনাম) বলেন, “রাতে যেভাবে ট্রাক চলে, মনে হয় কোনো দানবের শ্বাস পড়ছে গ্রামের ওপর। আমরা ঘুমাতে পারি না, আর প্রশাসন ‘তদন্ত করছি’ বলে দায় ঝেড়ে ফেলে।”
গ্রামের ভুক্তভোগী আলি হোসেন, যিনি সাড়ে এক একর জমির মালিক বলেন, “আমাদের না জানিয়েই জমির মাটি কেটে নিচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা—সবাই টাকা খেয়ে চুপ। আমরা পুরোপুরি অসহায়।”
তার মতে, সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, নদীর পাড় ও বেড়িবাঁধ পর্যন্ত কেটে ফেলা হচ্ছে। এতে করে নদীভাঙন, সড়ক ধস এবং বসতঘর বিলীনের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ও নদীতীরবর্তী এলাকা পড়েছে ঝুঁকির মুখে।
অভিযোগ রয়েছে, এই পুরো প্রক্রিয়া চলছে একটি ঊর্ধ্বতন সিন্ডিকেটের নিরব সহযোগিতায়। মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলকে ‘ম্যানেজ’ করেই বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই তাণ্ডব। মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযানে জরিমানা করলেও পরদিন থেকেই আবার শুরু হয় মাটি কাটার মহোৎসব।
এলাকাবাসীর মতে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে দায় এড়িয়ে যাওয়া এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর এঅবস্থা চলতে থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে চলে যেতে দেখা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নদীতীরবর্তী বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে দুই–তিন বছরের মধ্যে পুরো গ্রাম নদীতে চলে যাবে। তখন প্রশাসনের চোখ খুলবে, কিন্তু ততদিনে আমরা শেষ হয়ে যাবো।”
অপরাধের রাজত্বে এখন নিরাপদ নয় রামুর ফুঁয়ারচরের কৃষিজমি, নদীর পাড়, বসতঘর কিংবা সাধারণ মানুষ। আর ভূমিদস্যু জামশেদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস কারও নেই—কারণ ভয়, প্রভাব, আর টাকার খেলা সবকিছু ঢেকে দিয়েছে।
এভাবেই প্রাকৃতিক সম্পদ আর ফসলি জমির ওপর চলছে পৈশাচিক অত্যাচার। স্থানীয়দের মুখে যেন একই প্রশ্ন—এখানে কি রাষ্ট্র নেই? আইন নেই? নাকি টাকার কাছে সবকিছু বিক্রি হয়ে গেছে?
রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রাশেদুল ইসলাম বলেন, “এলাকার মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। তবে, তাদের ধ্বংসযজ্ঞ এখনও চলমান, যা একটি দুঃখজনক সত্য। তবে আমি আশ্বস্ত করছি, এসিল্যান্ড দায়িত্বে ফিরে এলে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর