
পিতার নিথর দেহের পাশে বসে পাথর হয়ে যাওয়া শিশু আনান। একফোঁটা শব্দ নেই মুখে, নেই কান্নার আওয়াজ—তবু তার চোখ দুটো চিৎকার করে বলছে, “আমার বাবা কোথায়?” আরমান শুধু ছায়ার মতো মায়ের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের ছোট্ট দুনিয়া ভেঙে খানখান হয়ে গেছে এক নির্মম খুনে। এই বয়সে যাদের হাতে বই-খাতা থাকার কথা, তারা আজ শিখছে মৃত্যুর সংজ্ঞা, শিখছে হারানোর ভয়াবহতা।
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং পশ্চিম পাড়ায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে গত ৬ এপ্রিল নৃশংসভাবে খুন হন তাদের বাবা আব্দুল মান্নান। একই ঘটনায় প্রাণ হারান মান্নানের আপন বোন শাহিনা বেগম ও জেঠাতো ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এই তিনটি প্রাণহানির সঙ্গে সঙ্গে যেন নিভে গেলো একটি ঘরের আলো। আনান আর আরমানের ছোট্ট পৃথিবী ছিল তাদের বাবা—যিনি হাসতেন, আদর করতেন, স্কুলে পৌঁছে দিতেন, রাতে পাশে ঘুমাতেন। আজ সেই বাবা কফিনে। সেই হাসি আজ নিথর।
স্থানীয়রা জানায়, খুনের ঘটনার ঠিক পরদিন দুপুরে জানাজা শেষে একসঙ্গে দাফন করা হয় তিনজনকে। জানাজার দৃশ্য ছিল এমন এক আবেগঘন পরিবেশ, যেখানে মজবুত পুরুষও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। আর আনান ও আরমান কেবল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল, একবারও চোখ সরায়নি কবরের দিক থেকে। যেন সেখানেই লুকানো তাদের পুরো পৃথিবী।
ঘটনার পরদিন নিহত মান্নানের স্ত্রী সাবিনা আক্তার উখিয়া থানায় মামলা করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই তপু বড়ুয়া জানান, এজাহারে ছয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে—আবুল ফজল বাবুল, মাহমুদুল হক, আব্দুল হামিদ, সালাহউদ্দিন, মর্তুজা হাসান রানা ও মো. রায়হান। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন।
কিন্তু এ খবরগুলো আনান-আরমানের কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের দরকার ছিল শুধু বাবা। রাতে বাবার কোল, সকালে বাবার আদর। সেই আশ্রয়, সেই নিরাপত্তা আজ চিরতরে ছিনিয়ে নিয়েছে এক নিষ্ঠুর সহিংসতা।
এলাকাবাসী বলেন, জমি নিয়ে যতই বিবাদ থাকুক, হত্যাই তো শেষ কথা হতে পারে না। যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তারা শুধু তিনটি প্রাণ নয়, ভেঙে দিয়েছে দুটি নিষ্পাপ শিশুর পুরো ভবিষ্যৎ।
শোক, ক্ষোভ আর প্রশ্নের জ্বালায় জর্জরিত চারপাশ। কিন্তু সবচেয়ে গভীর শোকটা লুকিয়ে আছে আনান আর আরমানের চোখে—যেখানে এখনো প্রতীক্ষা, হয়ত বাবা ফিরে আসবেন... অথচ সেই অপেক্ষা এখন চিরন্তন।
স্থানীয়দের আবেগঘন বক্তব্য: "আজ আমরা শুধু তিনটি প্রিয় জীবন হারাইনি, আমরা হারিয়েছি আমাদের আত্মবিশ্বাসও,"—এমনটাই বলছিলেন কুতুপালং পশ্চিম পাড়ার এক বৃদ্ধ। তার চোখে অশ্রু ছিল, কিন্তু মুখে হতাশার তিক্ততা। "এই ঘটনায় শুধু পরিবারটাই নয়, পুরো এলাকা শোকাহত। আজ আমাদের শিশুরা নিরাপদ নেই, আজ আমরা সবাই নিরাপত্তাহীন। একে অপরের মধ্যে এই ঘৃণা কেন? আমাদের তো একসাথে বাঁচতে হবে।"
একই এলাকার আরেক মহিলা আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আনান আর আরমানের চোখে বাবা না থাকার যে যন্ত্রণা, তা পৃথিবীর কোনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তারা ছোট, কিন্তু বুঝতে পারছে—তাদের জীবন থেকে এক মানুষ হারিয়ে গেছে। তারা কিভাবে বাঁচবে? কেউ যদি তাদের পাশে দাঁড়াতো, হয়ত আজ এই পরিস্থিতি হতো না।"
"এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আমাদের কুঁড়ে দিয়েছে, আমাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। কতটুকু আর সহ্য করতে হবে আমাদের?"—এ কথা বলছিলেন স্থানীয় এক যুবক। "তাদের পরিবার একসময় খেতে পেতো, আনন্দে থাকতো, কিন্তু আজ সেই পরিবারে শুধু শোক আর ক্ষত। মান্নান ছিল একজন সৎ মানুষ, তিনি কোনোদিন ভাবতে পারেননি এমন নির্মমতা তার সঙ্গে ঘটবে।"
"যে শিশুরা তার কাছে সুখী ছিল, এখন তারা কিভাবে বাঁচবে?"—এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না কুতুপালং পশ্চিম পাড়ার এক শিক্ষিকা। "এই দুঃখভরা চোখগুলো, এই নিরব কান্না—এ যেন এক মানবিক বিপর্যয়।"
মান্নান হত্যার পর পরই দুই শিশু আনান ও আরমান যেন বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারেনি। তারা শুধু কবরের পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার বাবা কোথায় গেছে? বাবা কেন কিছু বলল না?” এমন কথায় উপস্থিত মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠে। কেউ সান্ত্বনা দিতে গেলেও কান্না আর জড়ানো গলায় শুধু বলে, “আমার বাবার জন্য কেউ দাঁড়াবে না?” এই প্রশ্নে যেন আকাশ-বাতাসও নিঃশব্দ হয়ে যায়।
“আমার বাবা খারাপ কিছু করেনি”— বলেই বারবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আরমান। শিশুটি একটানা বলতে থাকে, “আমার বাবা তো কাউকে কষ্ট দিত না। কেন এমন হলো?”
একজন প্রতিবেশী জানান, জানাজার সময় আরমান বলছিল, এটা তো আমার বাবার জামা না, এটা কেন পড়িয়েছে?” এই কথা শুনে উপস্থিত শত শত মানুষ কান্না থামাতে পারেননি। বাবা নেই, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত—একটি পরিবারের আশ্রয় কবরের নিচে মান্নান ছিলেন পুরো পরিবারের মূল ভরসা। কর্মঠ, পরিশ্রমী একজন মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি দিন-রাত খেটে দুই সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে চাইতেন। কিন্তু আজ সেই সংসারে নেই কোনো আর্থিক নির্ভরতা, নেই ভবিষ্যতের আশ্বাস।
“ভাত তো দূরের কথা, দুই শিশুর মুখে পানি তুলে দেওয়ারও মানুষ নেই”— চোখ মুছতে মুছতে বললেন মান্নানের বৃদ্ধা মা তিনি আরও বলেন, “মান্নান ছিল আমার শেষ আশা। এখন শুধু চোখের জল আর দুটি এতিম নাতি। আমি বাঁচলেও কী, মরলেও কী।”
একজন মেম্বার আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড আমাদের মানবতা ও বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যারা পরিকল্পনা করে এমন জঘন্য কাজ করেছে, তারা শুধু আইন ভাঙেনি, তারা শিশুদের জীবন চিরতরে দুর্বিষহ করে দিয়েছে।”
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর