
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে বহুল বিতর্কিত কক্সবাজার কার্যালয়ের সাবেক সহকারী পরিচালক এ.কে.এম দিদারুল আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তার অতীতের দুঃসাহসিক দুর্নীতি, সাংবাদিক নেতাদের ক্ষোভ, মাদক চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং ভুক্তভোগীদের আর্তনাদ উঠে আসতেই গণ চাপে শেষ পর্যন্ত তাকে তদন্ত থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয় অধিদপ্তর।
সাংবাদিককে মাদক মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা, মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে উলটো মাদক কারবার, টাকার বিনিময়ে মামলা বাণিজ্য—এমন কোনো দুঃসাহসিক অপকর্ম নেই, যা কক্সবাজারে দিদারুল আলম করেনি বলে অভিযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় এতটাই ভারী হয়ে উঠেছিল যে, শেষমেশ তাকে কক্সবাজার থেকে প্রত্যাহার করে রংপুর বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। অথচ বিস্ময়করভাবে এতসব বিতর্ক, অনিয়ম ও দুর্নীতির ইতিহাস থাকার পরও তাকে ফের স্পর্শকাতর তদন্ত দায়িত্বে বসানো হলো—এতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
সচেতন মহল বলছেন, চট্টগ্রাম বিভাগের প্রভাবশালী অতিরিক্ত পরিচালক জাহিদ হোসেন মোল্লার ছত্রছায়া না থাকলে দিদারুল আলমের এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস হতো না। মাদকের মামলার তদন্তের মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব কীভাবে একাধিকবার দিদারের হাতে তুলে দেওয়া হলো, তা নিয়েও উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন। ভেতরের সূত্র বলছে, জাহিদ হোসেন মোল্লার প্রত্যক্ষ মদদেই দিদার কেবল ক্ষমতাবানই হননি, বরং বিচারপ্রক্রিয়াকে নিজের মতো মোড় দেওয়ার সুযোগও পেয়েছেন। এই অশুভ যোগসূত্রের কারণে অনেক নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছেন, আর প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসনের একাংশে গুঞ্জন—জাহিদের প্রশ্রয়েই দিদার মাদক সিন্ডিকেটের ‘অন্তরালের খেলোয়াড়’ হয়ে উঠেছেন, যার প্রভাব শুধু কক্সবাজারেই নয়, গোটা চট্টগ্রাম বিভাগজুড়েই অনুভূত হচ্ছে। এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরও পুষ্ট করে, আর দিদারের মতো দুর্বৃত্তদের আরও বেপরোয়া করে তোলে।
দৈনিক মেহেদীর নির্বাহী সম্পাদক মো: নাজিম উদ্দিন বলেন, “মাদকের কালসাপ দিদারুল আলম, যে একজন পুলিশ অফিসারের ছদ্মবেশে কক্সবাজারের মাদক চক্রের অন্যতম প্রধান সহযোগী হিসেবে পরিচিত, তার অপরাধের তালিকা এত দীর্ঘ যে তা গুণে শেষ করা দায়। এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা শুধু মাদক ব্যবসায়ী নয়, বরং নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার মাস্টারমাইন্ড। দিদারের শেকড় মাদক চোরাচালান, ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর শোষণমূলক অপকর্মে এমনভাবে রচিত যে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে একমাত্র উপায় ছিল ভয়, হুমকি ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো। গণমাধ্যমের ও সাধারণ জনগণের চোখে সে এক নিষ্ঠুর দুর্নীতিবাজ, যে তার রাজনৈতিক প্রভাব আর প্রশাসনিক অবস্থান ব্যবহার করে মাদক চক্রের কালসাপের মতো একে অপরকে শিকার বানিয়েছে। তার অপরাধের দিক থেকে কক্সবাজারের সমাজের যে কালো অধ্যায়, তার ভিত্তি হিসেবে দিদার এক অশুভ নাম হয়ে উঠেছে। এর শেষ কোথায়—অথবা কীভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এটা এখনো স্পষ্ট নয়, কিন্তু এই কালসাপের কোনো একদিন কঠিন বিচার হবে, এই প্রত্যাশা সকল মানুষের।”
ভুক্তভোগীদের বিস্ফোরক বক্তব্য:
সময়ের কণ্ঠস্বর এর কক্সবাজারস্থ স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ও স্থানীয় দৈনিক মেহেদীর অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর শাহীন মাহমুদ রাসেল বলেন—“দিদার হচ্ছে কক্সবাজার মাদক সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তা। আমি নিজে তার প্রতিহিংসার শিকার। কিছুদিন আগে আমার নামে চক্রান্ত করে মিথ্যা অভিযোগ আনতে উদ্যত হয়েছিল, কারণ আমি তার ও তার আশ্রয়দাতাদের অপকর্ম প্রকাশ করেছিলাম। তার হাতে তদন্ত মানেই বিচারহীনতার নতুন অধ্যায়।”
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী, যিনি আগে দিদারের বিরুদ্ধে মাদকের অধিদপ্তরের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেন—“দিদার টাকা না পেয়ে আমাকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসাতে চেয়েছিল। আমার দোকানে নিজের লোক দিয়ে প্যাকেট রেখে রেইড করেছিল। পরে স্থানীয় সাংবাদিকরা পাশে দাঁড়ালে বাঁচি। এখন এমন একজন তদন্ত করবে শুনে গা শিউরে ওঠে।”
মনছুর আলম নামের এক সাংবাদিক বলেন—“এই দিদারকে মানুষ ‘মাদক সিন্ডিকেটের ক্যাশিয়ার’ বলে ডাকে। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাকে দায়িত্ব দেওয়া মানে দুর্নীতিকে পুরস্কৃত করা।”
আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়া:
স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের নেতা এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন—“যারা এক সময় নিজেই অপরাধে জড়িত ছিলেন, তারা কীভাবে অপরাধ তদন্ত করবেন? এই দিদারকে বাদ দেওয়া হয়েছে গণদাবির কারণে, এটা প্রশাসনের জন্য সতর্কবার্তা হওয়া উচিত।”
এ বিষয়ে ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, “দিদারুল আলমের পাপের সাম্রাজ্য এতটাই বিস্তৃত ও গভীর ছিল যে, কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি শুধু মাদক কারবারেই জড়িত ছিলেন না, বরং তার অপকর্মে এই কার্যালয়ের কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তারা দিদারের দুর্বল দিক জেনে ফেলার পর, সেই দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে এবং তাদের সঙ্গে সুবিধাজনক সম্পর্ক বজায় রাখতেই দিদার কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা স্পর্শকাতর অভিযোগে চলা তদন্তভার পেতে উচ্চপদস্থদের কাছে আবেদন করতেন।”
এরমধ্যে “একজন সাংবাদিককে মাদক মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা দিদারের চক্রান্তের অংশ ছিল, যা সারা দেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষমেশ তাকে কক্সবাজার থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।”
তবে এখানেই থেমে থাকেনি দিদারের অপকৌশল। জসিম উদ্দিন অভিযোগ করেন, “দিদার তার দীর্ঘদিনের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ কিছু প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহায়তায় চলমান তদন্ত থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যান। এই প্রভাবশালী চেইন তাকে তদন্তের বাইরে রাখতে বারবার তৎপর ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ এপ্রিল তিনি আবারও কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্তভার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।”
ঘটনাটি জানার পর জসিম উদ্দিন নিজে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে “আমার হস্তক্ষেপের পরই উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় দিদারকে আবারও তদন্ত দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, প্রশাসনের অভ্যন্তরে এখনো একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে, যারা দিদারের মতো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে,” বলেন জসিম উদ্দিন।
গণ চাপ, সংবাদমাধ্যমের প্রবল প্রতিবাদ এবং ভুক্তভোগীদের জোরালো অবস্থানের ফলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অবশেষে সহকারী পরিচালক দিদারুল আলমকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। পরিচালক (প্রশাসন, অর্থ ও পরিকল্পনা) মো. মাসুদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে দায়িত্বমুক্ত করা হয়।
সাংবাদিকসহ সচেতন মহলের ভাষ্য— “জনমতের চাপ এবং গণমাধ্যমের সোচ্চার ভূমিকা না থাকলে হয়তো দিদার আজও বিচারকার্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে থাকতেন। এখন প্রত্যাশা, এই মামলাগুলোর সঠিক, নিরপেক্ষ এবং সাহসী তদন্ত হবে এবং প্রকৃত অপরাধীরা আইনের আওতায় আসবে। এটা শুধু একটা সিদ্ধান্ত নয়, এটা অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের বিজয়।”
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মোস্তাক আহমেদ বলেন, “তাকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল—এ কথা সত্য। তবে বিষয়টি মাননীয় মহাপরিচালক (ডিজি) মহোদয়ের দৃষ্টিগোচর হলে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে দিদারুল আলমকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেন।”
তিনি আরও জানান, অধিদপ্তর কোনোভাবেই বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তার দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত পরিচালনার পক্ষে নয় এবং ভবিষ্যতেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে কোনও আপস করা হবে না।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর