
“ফরিদ যেন উখিয়ার দাউদ ইব্রাহীম।” স্থানীয়দের মুখে মুখে ফিরছে এই ভয়াল উপমা। কক্সবাজারের উখিয়ায় মাদক, চোরাচালান আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক ত্রাণ বাণিজ্যের যে অন্ধকার জগত—তার কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছেন একাই ফরিদ।
সীমান্ত দিয়ে ইয়াবার চালান আসে, ক্যাম্পের মধ্যে গুদামজাত হয়, শহরে পৌঁছায়—আর সব কিছুর ওপর থাকে ফরিদের নিয়ন্ত্রণ। তার বিরুদ্ধে একাধিক মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালানসহ ডজন খানেক মামলা রয়েছে। মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার হন, আবার কিছুদিনের মধ্যে ছুটে বেড়ান বীরদর্পে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগেই গায়েব হয়ে যান, আবার ঠিক সময়মতো ফিরে এসে সাম্রাজ্যের হাল ধরেন। এমনকি অনেক সময় তার বাড়িতেই চলে নামমাত্র অভিযান—ফল থাকে শূন্য। এমন অভিযোগ বেশ পুরোনো।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ফরিদের একটি সুসংগঠিত বাহিনী রয়েছে, যারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত নিয়ন্ত্রণ করে ত্রাণ মালামাল, কার্ড বিতরণ ও পণ্য পাচারের সিন্ডিকেট। ক্যাম্পে ‘ফরিদের লোক’ ছাড়া কেউ স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা করতে পারে না। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও তার যোগাযোগ এতটাই গভীর, যে নতুন চালান ঢুকলে আগে খবর যায় ফরিদের ঘরেই।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং মাদকের বিপুল অর্থ—এই তিনে ভর করে উখিয়ায় ফরিদ আজ শুধু অপরাধী নন, তিনি হয়ে উঠেছেন একটি অপরাধ-ব্যবস্থার প্রতীক। মানুষ জানে, কেউ কিছু করতে পারবে না। মিডিয়ায় প্রতিবেদন হয়, মামলা হয়, হয়ত অভিযানের গাড়িও আসে—কিন্তু সাম্রাজ্য অটুট থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি অত্যাধুনিক অপরাধ প্রক্রিয়া—‘ফেইক ক্যারিয়ার, হিডেন কিং’। মুখস্থ করা ডায়ালগ, নিয়ন্ত্রিত হ্যান্ডলার, প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গা ক্যারিয়ার—সব মিলিয়ে এক নিখুঁত অপরাধ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সর্বেসর্বা বালুখালীর চিহ্নিত ইয়াবা গডফাদার ফরিদ ওরফে চিয়ক ফরিদ।
স্থানীয়রা বলেন, “ফরিদ এখন আর শুধু কারবারি নয়, সে পুরো একটা রাজনৈতিক ‘কটকট’ সিস্টেমের অংশ।” আওয়ামী লীগ শাসনামলে স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছায়ায় থাকলেও, সরকার পরিবর্তনের গন্ধ পেলেই চলে গেছে বিএনপির ছায়ায়। সাবেক এক যুবদল নেতাকে কোটি টাকার ডোনেশন দিয়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যাচ্ছে, যেন পরবর্তী সময় নিজেকে রাজনৈতিক 'আশ্রয়প্রাপ্ত' হিসেবে সাজাতে পারে।
বিজিবির তথ্য বলছে, বালুখালী এখন কেবল একটি এলাকা নয়, এটি একটি মাদক করিডোর, যেখানে ফরিদের সিন্ডিকেট কর্তৃত্ব করে। গত ৮ মার্চ, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০ ফেব্রুয়ারি—তিনটি বড় অভিযানে প্রায় ৮০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জায়গা একটাই—বালুখালী। অথচ, বারবার তদন্তে এক জায়গায় এসে প্রশাসনের জিজ্ঞাসাবাদ থেমে যায়—“মালিকের পরিচয় পাওয়া যায়নি।”
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফরিদের মেজ ভাই, চিহ্নিত ইয়াবার গডফাদার জাফর আলম। র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হওয়ার পর থেকেই ফরিদ তার ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়ে এই অপরাধ সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা অস্ত্রধারীদের দিয়ে বিশাল একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে দুই দেশের চোরাচালান সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, বালুখালী কেন্দ্রিক যত ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে, তার সব কিছুর পেছনে ফরিদের হাত রয়েছে। প্রশাসনের দাবি, দৃশ্যমান প্রমাণের অভাবে তারা ফরিদকে আটক করতে পারছে না।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি উখিয়া থানার অভিযানে ফরিদের মালামালসহ চোরাচালানি গাড়ি জব্দ করা হয় এবং মামলাও দায়ের হয়। এছাড়াও রামু সদরসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ফরিদের বিরুদ্ধে অন্তত ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।
মাদকের মাস্টারমাইন্ড:
বালুখালী সীমান্ত ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে ইয়াবার চালান প্রবেশ করায় ফরিদের গোষ্ঠী। এসব মাল প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপদে রাখা হয়, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, এমনকি ঢাকায়। অভিযানে ধরা পড়া অধিকাংশ চালানের পেছনে ফরিদের নাম এলেও তার বিচার হয়নি আজও।
মামলা আছে, বিচার নেই:
ফরিদের বিরুদ্ধে বহু মামলার নথি থাকলেও বাস্তবে তার নাম অনেক সময় থাকে গোপনে, বা তদন্ত প্রতিবেদনে ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে রাখা হয়। সূত্রমতে, তিনি রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ‘পিছিয়ে আসতে’ হয়।
ত্রাণ সিন্ডিকেটেও আধিপত্য:
মাদক ছাড়াও বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাল-ডাল, ত্রাণপণ্য, এমনকি গৃহনির্মাণ উপকরণের সিন্ডিকেটও ফরিদের নিয়ন্ত্রণে। তার নির্ধারিত লোকজন ক্যাম্পে ‘ডিল’ করে, কে কী পাবে, কত পাবে—সবই চলে তার অনুমতিতে।
স্থানীয়দের ভয় আর নীরবতা:
সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে ভয় পায়। তবু কেউ কেউ চুপিচুপি বলেন—“ফরিদের দল আছে, টাকা আছে, উপরে লোক আছে। আমরা শুধু চোরাচালান কারবার দেখি, বিচার দেখি না।”
মসজিদের ইমাম বলেন, “মাদক নিয়ে ওয়াজ করলে ফরিদের লোক এসে হুমকি দেয়। প্রশাসনের চেয়ে বেশি শক্তি তাদের।”
স্থানীয়রা মুখ খুলতে ভয় পায়। অনেকেই বলেন, “ফরিদের বিরুদ্ধে কথা বললে বিপদ আসে ঘরে। তার হাত অনেক লম্বা।”
স্থানীয় শিক্ষক জানান, “ক্যাম্পে যত ব্যবসা-বাণিজ্য হয় সব তার মাধ্যমে করতে হয়। নইলে হামলার শিকার হতে হয়।”
প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন:
প্রতিবার ঘটনা ঘটলে দেখা যায় বড় বড় অভিযান, দৃষ্টি নন্দন ব্রিফিং, কিছু গ্রেফতার—কিন্তু ফরিদ থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। প্রশ্ন উঠেছে—তাহলে কি তিনি শুধুই চক্রের গডফাদার, নাকি প্রশাসনের কোনো ছায়াতলে আশ্রিত রাঘব বোয়াল?
বারবার অভিযোগ, বারবার মামলা—তবুও ফরিদ কেন ধরা পড়ে না? প্রশাসন কি ব্যর্থ, না ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে আড়াল করা হচ্ছে? স্থানীয়দের প্রশ্ন, “জনগণকে দেখানোর জন্য অভিযান, আর গডফাদাররা রাজত্ব করে যাবে?”
একজন প্রবীণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলেন, “উখিয়ায় যত ইয়াবা ধরা পড়ে তার ৮০ ভাগের উৎস ফরিদ। প্রশাসন জানে, জনপ্রতিনিধিরা জানে, এমনকি ক্যাম্পের রোহিঙ্গারাও জানে। কিন্তু ধরার সাহস কই?”
অনেকেই অভিযোগ করছেন, এমনকি সম্প্রতি উখিয়া থানায় নতুন মামলাও হয়েছে। তবুও প্রশাসনিক অভিযানের পরদিনই তাকে দেখা যায় বাজারে, ক্যাম্পে, এমনকি রাজনৈতিক মঞ্চেও। ফরিদের এই দুর্ধর্ষ উত্থানের পেছনে প্রশাসনের একাংশের নীরব সম্মতি রয়েছে। অভিযান হয়, রিপোর্ট হয়, অথচ ফরিদের বাড়িতে কোনও তল্লাশি চালানো হয় না, হয় না তার অর্থনৈতিক অনুসন্ধানও। প্রশ্ন ওঠে—কেন? কারা আড়াল করছে তাকে?
একজন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকে মাটিচাপা দিয়ে দিচ্ছে কিছু স্থানীয় কর্মকর্তা। তারা যদি আন্তরিক হতেন, ফরিদ এখন কারাগারে থাকতেন।”
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, “এভাবে চলতে থাকলে উখিয়া শুধু মাদক জেলা নয়, আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের হাব হয়ে উঠবে।” তারা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ফরিদের সম্পদের হিসাব, রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং মাদক সংশ্লিষ্টতাসহ সার্বিক তদন্ত করে তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য।
স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক বলেন, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিচ্ছে এই ফরিদরা। সকালে স্কুলে যায়, বিকালে রোহিঙ্গাদের সাথে ইয়াবা বেচে! সমাজটাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ প্রশাসন নিরব!
বালু খালীর এক সমাজ কমিটির নেতা ক্ষোভের সাথে বলেন, “আজকে ফরিদ বিএনপির নেতাদের সাথে জোট বেঁধেছে, কাল অন্য কারো সাথে। এসব গডফাদারদের রাজনৈতিক আশ্রয় না থাকলে এতটা দুঃসাহস দেখাতে পারত না। এই ফরিদ, তার পরিবার, তার সিন্ডিকেট—সবাই মিলে পুরো এলাকা দখলে নিয়েছে। ওকে যদি এবার দমন না করা হয়, তাহলে উখিয়ায় ইয়াবা থামবে না।”
ফরিদের মতো ব্যক্তি শুধু একজন মাদক চোরাকারবারি নন, তিনি প্রশাসনিক ব্যর্থতা, রাজনৈতিক ছত্রছায়া আর অপরাধকে প্রতিষ্ঠা করার একটি প্রতিচ্ছবি। যতদিন এই গডফাদাররা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবেন, ততদিন উখিয়ার সীমান্তে শুধু ইয়াবা নয়—থাকবে ভয়, অনিশ্চয়তা এবং অপারাধের রাজত্ব। এমন অভিমত স্থানীয় সচেতন মহলের।
এ বিষয়ে জানতে ফরিদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে প্রতিবেদকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কথিত ফরিদ সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন, দাবি করেন তিনি ফরিদ নন। কিছুক্ষণ পর ওই নম্বর থেকেই হোয়াটসঅ্যাপে র্যাব কর্তৃক বারবার তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলে ধরা একটি সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও নিউজের লিংক পাঠানো হয়।
উখিয়া থানার ওসি আরিফ হোসেন সাফ জানিয়ে দেন, “কারো রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে কেউ পার পাবে না। ফরিদের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পেলে সে যেকোনো দলের হোক, আমরা গ্রেফতার করব।” ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. ফারুক হোসেন খান বলেন, “গডফাদারদের ধরতে আমাদের টিম সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে।
অনেক সময় দেখা যায়, যারা ইয়াবা বহন করে তারা জানেই না আসল মালিক কে। এই ধরনের সূক্ষ্ম সিন্ডিকেট ভাঙতে সময় লাগছে, তবে আমাদের ধৈর্য শেষ হয়নি।”
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর
জেলার খবর এর সর্বশেষ খবর