
কক্সবাজার সদরের খরুলিয়ার মুন্সিবিল এলাকায় মুশারফা সুলতানা লাকি (১৮) নামের এক তরুণী শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, তৈরি হয়েছে রহস্য আর চাঞ্চল্য। ওড়না পেঁচানো অবস্থায় মাটিতে পা রেখে ঝুলন্ত লাকির নিথর দেহ দেখে পরিবার ও স্থানীয়রা প্রথম থেকেই দাবি করে আসছেন; এটি আত্মহত্যা নয়, বরং ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যার পর নির্মমভাবে সাজানো হয়েছে আত্মহত্যার নাটক। স্বপ্নে ভরা চোখে জীবনের পথে হাঁটতে থাকা লাকি ছিলেন কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল সেই মেয়েটির এমন মর্মান্তিক পরিণতি আজ শুধু তার পরিবার নয়, পুরো খরুলিয়া এলাকাকে কাঁদাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) গভীর রাতে স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তার বাড়ি থেকে লাকির মরদেহ উদ্ধার করে। ঘটনার সময় বাড়ির দরজা-জানালা খোলা ছিল এবং লাকি একাই ঘরে ছিলেন বলে জানান স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীসহ তার পরিবার। পরিবারের সদস্যরা এবং স্থানীয়রা এই মৃত্যুতে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ বলে দাবি তুলেছেন।
নিহত তরুণীর পরিবার জানায়, স্থানীয় সৌদি প্রবাসী জাফর আলমের ছেলে ওসমান গনি বাবু (২৫) দীর্ঘদিন ধরে লাকির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক চালিয়ে আসছিলেন। একপর্যায়ে তারা গোপনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তবে বিয়ের পর তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। পরিবারের দাবি, লাকি সম্প্রতি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ধারণা করা হচ্ছে তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
লাকির মা ফাতেমা খাতুন বলেন,“ঈদের দিন আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে সে জানায়, ওসমানের সঙ্গে তার গোপনে বিয়ে হয়েছে। ঘটনার রাতে আমি বাড়িতে ছিলাম না। আমার মেয়ে একা ছিল। আমার বিশ্বাস, ওসমান এসে তাকে হত্যা করেছে এবং ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে।”
লাকির মা ফাতেমা খাতুন আরও জানান, ঘটনার দিন রাত ১২টা ১৯ মিনিটে অভিযুক্ত ওসমান তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর থেকে তাকে ফোন করেন। ফোনে তিনি জানতে চান, “লাকি ফোন ধরছে না কেন?” এই প্রশ্নে তিনি বিস্মিত হয়ে নিজেই বারবার মেয়েকে কল করতে থাকেন। কিন্তু লাকি কোনো সাড়া দেয়নি। তখনই মায়ের মনে আশঙ্কা জাগে, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে।
লাকির ভাই মাহমদুল্লাহ বলেন, “ঘটনার রাতে আমাদের দরজায় কেউ জোরে জোরে ধাক্কা দেয়। কিছুক্ষণ পরেই খবর পাই, বোনের লাশ ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। গিয়ে দেখি, গলায় ওড়না পেঁচানো এবং পা মাটিতে ঠেকা অবস্থায় লাশটি পড়ে আছে।”
চাচি আনোয়ারা বেগম জানান, “তারা গোপনে বিয়ে বলে একটু একটু জানতে পেরেছি। কোন একটি কারণে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। কেউ বাড়িতে না থাকার সুযোগে ওসমান একা পেয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।”
স্থানীয় সমাজসেবক সৈয়দ নুর হেলালী বলেন, “লাশ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এটি আত্মহত্যা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আত্মহত্যার বিষয়টি সাজানো হয়েছে।”
এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায় বলে অভিযোগ পরিবারের। নিহত লাকির মা জানান, “থানায় গেলে উলটো ধমক দেওয়া হয়। আমাদের অভিযোগ শোনাও হয়নি।”
স্থানীয় শামসুল আলম জানান, ঘটনার রাতে তিনি লাকির বাড়ির পাশের একটি কদম গাছের নিচে অভিযুক্ত ওসমানকে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত অবস্থায় দেখতে পান। তার আচরণ তখন সন্দেহজনক মনে হয়েছিল।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল গফুর ও নুরুল আলম জানান, ওই রাতে তারা লাকির ঘরের দরজা-জানালাসহ বাড়ির সবকিছু খোলা দেখতে পান। প্রথমে তারা ধারণা করেন, বাড়িতে চোর ঢুকেছে। লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে তারা লাকির মরদেহ দেখতে পান।
এদিকে, তরুণীর ঝুলন্ত লাশের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা গেছে, মৃতদেহটি পুরোপুরি ঝুলে ছিল না, বরং হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে থাকার মতো অবস্থা ছিল। বিষয়টি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—যদি এটি আত্মহত্যা হয়, তবে দেহ কেন মাটিতে থাকবে?
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত ওসমানের পরিবার আর্থিকভাবে প্রভাবশালী। তারা টাকার প্রভাবে থানাসহ সংশ্লিষ্ট মহলকে প্রভাবিত করে পুরো ঘটনাটি আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে লাকির রহস্যজনক মৃত্যুতে এলাকাবাসী ও নেটিজেনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তারা এই ঘটনাকে আত্মহত্যা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যা বলে দাবি করছেন।
স্থানীয়দের মতে, লাকির মরদেহের অবস্থান এবং আশপাশের পরিবেশ আত্মহত্যার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদি এটি আত্মহত্যা হতো, তবে তার শরীর সম্পূর্ণভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, তার পা মাটিতে স্পর্শ করছিল এবং ঘরের আসবাবপত্র, যেমন টেবিলে রাখা পানির গ্লাস, অক্ষত ছিল। এটি স্বাভাবিক নয়, কারণ আত্মহত্যার সময় শরীরের ওজনের কারণে আশপাশের জিনিসপত্রে প্রভাব পড়ে।
এছাড়া, লাকির পরিবারের দাবি, স্থানীয় ওসমান গনি বাবু, যার সঙ্গে লাকির প্রেমের সম্পর্ক ছিল, তাকে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, ওসমানের পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করছে।
এই ঘটনায় এলাকাবাসী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় নেটিজেনরা সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, "এটি আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত হত্যা। আমরা ন্যায়বিচার চাই। লাকির পরিবার সুষ্ঠু তদন্ত, দোষীদের গ্রেপ্তার এবং পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা দাবি করেছে। এ নিয়ে এলাকায় চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগ বিরাজ করছে।
প্রতিবেদককে পাঠানো এক ভয়েস মেসেজে ওসমানের এক আত্মীয় জানান, “আমার ভাই ওসমানের সঙ্গে ওই তরুণীর সম্পর্কের বিষয়টি জানতে পেরে আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম—এলাকার মধ্যে এমন সম্পর্ক না রাখাই ভালো। তখন ওসমান আমাকে জানিয়েছিলেন, লাকি আরও একাধিক সম্পর্কে জড়িত, তাই তিনি আর তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। যদি সত্যিই ওসমান তাকে হত্যা করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার বিচার হওয়া উচিত। তবে যদি সে নির্দোষ হয়, তাহলে তাকে যেন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো না হয়—সে অনুরোধও জানাই।”
অভিযুক্ত ওসমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সরাসরি তার বাড়িতে গিয়েও তাকে কিংবা পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।
এই বিষয়ে জানতে কক্সবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইলিয়াস খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্র্যাফিক) মো. জসিম উদ্দিন জানান, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শাকিল/সাএ
সর্বশেষ খবর