
কক্সবাজারের রামুর ফুঁয়ারচর যেন আজ নিঃস্ব এক জনপদের নাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই এলাকার মাঠে একসময় যেখানে শস্যে ভরে থাকত কৃষকের ঘর, এখন সেখানে দেখা যায় শুধু গর্ত আর ধুলোর ধোঁয়া।
বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষা এই জনপদে প্রতিদিন দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মাটি লুটের মহোৎসব। স্কেভেটর দিয়ে মাটি কাটা, ডাম্পার-ট্রাকে করে শত শত ঘনফুট মাটি পাচার-এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে এলাকারই বাসিন্দা জামশেদ।
বছরের পর বছর ধরে সংবাদমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও রহস্যজনক কারণে কোনো ধরনের দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। বরং অভিযোগ উঠেছে, মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রশাসনের একাংশ এই প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞে হয়ে উঠেছে মদতদাতা।
এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের নাম ফুঁয়ারচর:
স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, ফুঁয়ারচরে মাটি কাটা এখন নিয়মিত ‘উৎসব’। দিনে-রাতে চলছে ট্রাক-ডাম্পারের গর্জন। কলঘর বাজার সংলগ্ন এলাকায় গভীর গর্ত তৈরির ফলে ইতোমধ্যেই বিলীন হয়েছে কৃষি জমি। সেখানে এখন আর ধান-সবজি নয়, দেখা যায় মাটির স্তূপ আর ট্রাকের চাকা।
সাড়ে এক একর জমির মালিক আলি হোসেন জানান, “আমাদের না জানিয়েই মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা কেউ মুখ খুলছে না। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, নদীর পাড় ও বেড়িবাঁধ পর্যন্ত কেটে ফেলা হচ্ছে। এর ফলাফল ভয়াবহ হবে।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে থাকা জামশেদ প্রায় এক দশক ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জমির মালিকদের ভয় দেখিয়ে কিংবা অর্থের লোভ দেখিয়ে রাজি করিয়ে মাটি কেটে নিচ্ছে তারা। কেউ প্রতিবাদ করলেই হামলা-মামলার হুমকি আসে।
একজন যুবক সোলাইমান বলেন, “প্রশাসন কিছু জানে না—এটা বিশ্বাস করি না। মাঝে মাঝে নাটক করে কিছু গাড়ি জব্দ করে, কিন্তু পরদিন আবার আগের মতোই চলতে থাকে কাজ।”
অথচ রামু উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
কৃষকরা দিশেহারা, পরিবেশ বিপন্ন:
প্রবীণ কৃষক আবদুল কুদ্দুস বলেন, “তিন পুরুষ ধরে এই জমিতে চাষ করি। এখন শুধু গর্ত। আমি ধান ফলাবো, না মাটি বিক্রি করবো?” নারী কৃষক ফাতেমা বেগম বলেন, “ডাম্পারের ধুলায় ঘরের কাপড়ও শুকাতে পারি না, ফসল মরে যায়। কেউ শুনছে না আমাদের কথা।”
পরিবেশবিদদের মতে, উর্বর কৃষিজমি হারানোর পাশাপাশি নদীর পাড় কাটার ফলে বাড়ছে নদীভাঙনের ঝুঁকি, হুমকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।
এই পরিস্থিতিকে শুধু ফুঁয়ারচরের সংকট বললে ভুল হবে। এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতার চিত্র, যেখানে আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। যেখানে সাধারণ মানুষ শ্বাস নিতে পারছে না-ভয়, হুমকি আর ধ্বংসের মাঝখানে।
প্রশ্ন থেকেই যায়-কবে থামবে এই ‘মাটি ব্যবসা’? আদৌ কি প্রশাসন জাগবে? নাকি জনগণের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেই চলবে এই নৈরাজ্য? এমন প্রশ্ন স্থানীয়দের।
সচেতন মহলের দাবি-দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করলে এই চক্র আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। এখনই সময় প্রশাসনের ঘুম ভাঙানোর।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাশেদুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেন নি।
মুনতাসির/সাএ
সর্বশেষ খবর