
টেকনাফ সীমান্ত এক সময় শুধুই মাদকের রুট হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন এই জনপদ আরেকটি ভয়ঙ্কর চক্রের দখলে- পাহাড়কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে এক ‘অপহরণ সাম্রাজ্য’। পাহাড় ঘেরা হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী এমনকি কৃষকরাও আজ এই চক্রের ভয়ংকর টার্গেট। অপহরণের পর দাবি করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ। কেউ না পেলে শারীরিক নির্যাতন বা জীবননাশের হুমকি- এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সোমবার (২১ এপ্রিল) সন্ধ্যায় টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পশ্চিম মহেশখালীপাড়ায় এমনই একটি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী। অভিযানে অপহরণকারী দলের সদস্য মোহাম্মদ রফিক (২৭) গুলিবিদ্ধ হন। তার বিরুদ্ধে একাধিক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ মডেল থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন। বর্তমানে রফিক কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্থানীয়দের মতে, চক্রের সদস্যরা সাধারণত সন্ধ্যার পর পাহাড়ি গোপন পথ ধরে জনবসতিতে নামে। তারা টার্গেট করে অর্থবান পরিবার, একাকী চলাফেরা করা ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীকে। অপহরণের পর ভুক্তভোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ি গুহায়- যেখান থেকে শুরু হয় মোবাইল ফোনে মুক্তিপণ দাবির নাটক।
এই অপহরণ চক্রে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারা অত্যাধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বারবার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং পাহাড়ি দুর্গম পথ ব্যবহার করায় অভিযান চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “চক্রটি আধা-সামরিক কৌশলে চলে। তাদের আচরণ পরিকল্পিত ও গোছানো। যেকোনো সময় হানা দেয় এবং মুহূর্তেই গা ঢাকা দেয়।”
কেন বাড়ছে অপহরণ?
টেকনাফের পূর্ব পাশে মাত্র ৪ কিলোমিটার প্রশস্ত নাফ নদী; ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এই নদী পেরিয়ে সহজেই ইয়াবা ও আইসের চালান প্রবেশ করে বাংলাদেশে। অন্যদিকে হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে ৩ লাখ রোহিঙ্গার ১১টি আশ্রয়শিবির। এসব শিবির ঘিরে গড়ে উঠেছে অন্তত ১০-১২টি সশস্ত্র ডাকাত ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটি, যারা চাঁদা আদায়, মাদক কারবার এবং অপহরণে জড়িত। চাঁদা না দিলে অপহরণ করে নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে তারা।
পুলিশ সূত্র বলছে, গত এক বছরে টেকনাফ থানায় অপহরণের মামলা হয়েছে ২০টি। উদ্ধার করা হয়েছে ১৩৮ জন অপহৃতকে। এই চক্র মাদক ব্যবসায়ীরাও ব্যবহার করে থাকে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা টাকা হাতিয়ে নিতে। অনেকেই মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও থানায় মামলা করতে চান না- এটি পুলিশ-প্রশাসনের জন্য রহস্যজনক ও উদ্বেগজনক একটি দিক।
উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা রফিক উল্লাহ বলেন, গত এক বছরে ওই আশ্রয়শিবির থেকে পাঁচ শতাধিক বিয়ের উপযোগী তরুণ-তরুণীকে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়েছে। তিন শতাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ফিরে এসেছেন। বালুখালী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা কামাল হোসেন বলেন, মালয়েশিয়া পৌঁছার আগে থাইল্যান্ড কিংবা মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের আটকে রেখে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। তাতে ব্যর্থ হলে ওই পরিবারের সদস্যদের অপহরণের চেষ্টা চলে।
বিজিবি সূত্র জানায়, গত দেড় মাসে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে পাচারের সময় বিজিবি সদস্যরা অন্তত ৫ কেজি আইস ও ১৪ লাখ ইয়াবাসহ ৪০ জন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। বিজিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ৪ কিলোমিটারের নাফ নদী সাঁতরেও অনেকে ইয়াবা-আইসের বড় চালান টেকনাফ নিয়ে আসছেন।
মানব পাচার ও পাহাড়ি চক্রের জটিল যোগসূত্র: ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সাগরপথে মানব পাচার আবারও বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত এক বছরে ৪৫ জন পাচারকারীসহ উদ্ধার করেছে অন্তত ৬০০ জনকে। এসবের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। দালালরা মালয়েশিয়ায় চাকরি ও বিয়ের প্রলোভনে তাদের পাচার করছে। আবার মালয়েশিয়া যাওয়ার পথেই থাইল্যান্ড বা মিয়ানমারে আটকে রেখে পরিবার থেকে চাঁদা দাবি করা হয়। এতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের অপহরণ করাও চলে।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোর অবস্থান পাহাড়ি বনভূমিতে হওয়ায় পাহাড়ের ভেতরে সহজেই আস্তানা গড়ে তুলতে পারছে চক্রগুলো। জাদিমুরা, নয়াপাড়া, উনচিপ্রাংসহ আশ্রয়শিবিরগুলোর সংলগ্ন পাহাড়ি সড়ক ব্যবহার করে হোয়াইক্যং-বাহারছড়া ও হ্নীলা ইউনিয়নের মানুষ চলাচল করে। ফলে ওই এলাকার চাষি, শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপন্ন।
সীমান্ত জটিলতা ও ইয়াবা সাম্রাজ্য: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত এক বছর ধরে চলছে সরকারি বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর যুদ্ধ। ২১০ কিলোমিটার এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে গেলেও ইয়াবা কারবার থেমে নেই। সীমান্তের ওপারে এখনো সক্রিয় ৩৭টির বেশি ইয়াবা কারখানা। বিজিবি জানিয়েছে, গত দেড় মাসেই সীমান্ত দিয়ে পাচারের সময় তারা ৫ কেজি আইস, ১৪ লাখ ইয়াবা ও ৪০ পাচারকারী আটক করেছে। অনেকে নাফ নদী সাঁতরেও চালান নিয়ে আসছে।
পাহাড় ঘেরা টেকনাফে অপহরণ এখন এমন এক আতঙ্কের নাম, যা প্রতিটি সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। এমন মন্তব্য করে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. ইসমাইল (ছন্মনাম) বলেন, “আমার ছেলে স্কুল থেকে ফিরছিল বিকেলে। হঠাৎ ৩-৪ জন লোক মোটরসাইকেলে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। দুই দিন পরে ফোনে বলে- ‘পঁচিশ হাজার না দিলে ছেলেকে মেরে ফেলা হবে’। টাকা দেওয়ার পর ছেলেকে পাইলেও এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো।”
বাহারছড়ার কৃষক নুরুল আমিন (৫৫) বলেন, “আমি সকালে ক্ষেত দেখতে গেছিলাম। ফেরার সময় দুইজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী অস্ত্র নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আমাকে মারধর করে অনেক টাকা চায়। পরে এলাকার মুরুব্বিরা ম্যানেজ করে ছাড়া পাই। এরপর থেকে পাহাড়ে আর যাই না।”
হ্নীলা বাজারের দোকানদার রহিম উল্লাহ (৩২) বলেন, “ব্যবসা করছি ৮ বছর। কিন্তু এখন আর সন্ধ্যার পর দোকান খোলা রাখি না। কত মানুষ গায়েব হয়, সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক লাগে।”
জাদিমুরার এক নারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “আমার ভাইকে রোহিঙ্গারা উঠিয়ে নিয়ে গেছিল পাহাড়ে। মোবাইলে ফোন দিয়ে বলে- ‘এক লাখ লাগবে’। এত টাকা কোথা থেকে দিবো? এক সপ্তাহ পরে লাশ পাইছি।”
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “অপহরণের একাধিক ঘটনার তদন্তে মানব পাচার ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার যোগসূত্র মিলেছে। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এই চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।”
এই ভয়ঙ্কর ‘অপহরণ সাম্রাজ্য’ এখন অস্ত্রের গুলির চেয়ে বেশি ভয় সৃষ্টি করছে ভেতরে-ভেতরে। টেকনাফের জনপদে ফিরিয়ে আনতে হলে নিরাপত্তা ও সচেতনতা দুই-ই জরুরি। প্রয়োজন স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কৌশল, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পাহাড়ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি গোয়েন্দা তৎপরতা।এমন অভিমত স্থানীয়দের।
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর