
প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজন দলগত প্রচেষ্টা। এটি কেবল একটি বার্তামূলক স্লোগান নয় বরং প্রাণিস্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে একটি সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির জোরালো আহ্বান। প্রাণিস্বাস্থ্য সেবাকে সফল ও টেকসই করতে হলে শুধু প্রাণিচিকিৎসকদের ওপর নির্ভর করলেই চলবে না; বরং প্যারাভেট, খামারি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত অংশগ্রহণই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) প্যারাসাইটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাণি বিশেষজ্ঞ ড. মো. সহিদুজ্জামান।
ড. মো. সহিদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় দলগত প্রচেষ্টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের মোট জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১.৪৭ শতাংশ এবং প্রায় দুই থেকে তিন কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত। এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক খাত নয় বরং খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। তবে বাস্তবতা হলো এখনও অনেক খামার প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ঘাটতি, প্রযুক্তি ব্যবহারে দুর্বলতা এবং দলগত ব্যবস্থাপনার অভাব অনেক উদ্যোগকে অলাভজনক বা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়-একক প্রচেষ্টায় নয়, সম্মিলিত উদ্যোগেই প্রাণিস্বাস্থ্য নিশ্চিত সম্ভব।
ভেটেরিনারি পেশার ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক বলেন, এই মহৎ পেশার ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব এখনও অনেকের কাছে অজানা। সমাজে প্রাণিচিকিৎসকদের সাধারণত শুধু পশুর চিকিৎসক হিসেবেই দেখা হয়। অথচ তারা কেবল প্রাণির চিকিৎসাই করেন না। তাঁদের দায়িত্বের পরিধি বিস্তৃত খাদ্য নিরাপত্তা, রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান কর্মসূচি, গবেষণা, প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও স্মার্ট প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জিনগত উন্নয়ন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা, জিন বিশ্লেষণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং টেলিভেটেরিনারি সেবায় প্রাণিচিকিৎসকদের ভূমিকা ক্রমেই বাড়ছে।
এছাড়া তরুণদের জন্য খাদ্য তৈরি প্রতিষ্ঠান, ওষুধ উৎপাদন, মোবাইল ক্লিনিক বা খামারভিত্তিক উদ্যোগ গড়ে তোলার মধ্যে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা বলে জানান ওই অধ্যাপক।
তবে এখানেও বড় একটি ঘাটতি হলো ভেটেরিনারি অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞান ও চর্চার অভাব। এই বিষয়ে অধ্যাপক বলেন, একটি খামার লাভজনক হবে কিনা তা নির্ভর করে সঠিক খরচ-সুবিধা বিশ্লেষণ, বাজার মূল্যায়ন ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্তের ওপর। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থী ও খামারিরা জানেন না কীভাবে এসব বিশ্লেষণ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি খুরারোগ টিকার খরচ হতে পারে মাত্র ৫০ টাকা; কিন্তু টিকা না দিলে দুধ উৎপাদন ৩০–৪০ শতাংশ কমে গিয়ে হাজার টাকার ক্ষতি হতে পারে। এই সরল অথচ গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ যদি খামারিরা বুঝতেন, তাহলে তারা অধিকতর সচেতন ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক সহিদুজ্জামান।
অধ্যাপক আরো যোগ করেন, এজন্য ভেটেরিনারি কারিকুলামে 'ভেটেরিনারি অর্থনীতি ও খামার ব্যবস্থাপনা' বিষয়টিকে আরও প্রয়োগমুখী করে তোলা জরুরি। পাশাপাশি একটি জাতীয় ভেট ইকোনোমিক্স গবেষণা ইউনিট গঠন, খামারিদের জন্য অর্থনৈতিক সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ এবং একাডেমিয়া-সরকার-শিল্প খাতের মধ্যে বাজার বিশ্লেষণভিত্তিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
ওয়ান হেলথ সম্পর্কে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ পরবর্তী বাস্তবতায় ওয়ান হেলথ ধারণা বিশ্বব্যাপী নতুন গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা জানি, মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ-এই তিনের স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িত। র্যাবিস, ব্রুসেলোসিস বা যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগের বিস্তার ঠেকাতে চিকিৎসক, প্রাণিচিকিৎসক ও পরিবেশবিদদের সমন্বিত প্রচেষ্টাই সবচেয়ে কার্যকর। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত সময়োপযোগী হতে পারে। গবেষণা, শিক্ষা, মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম ও নীতিনির্ধারণ-সব পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারলে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায়ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে। এতে শিক্ষার্থী, গবেষক, প্রাণিচিকিৎসক, চিকিৎসক ও নীতিনির্ধারকদের একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্মে একত্র করা যাবে।
অধ্যাপক সবশেষে বলেন, “আমরা কতটা প্রস্তুত প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় সম্মিলিতভাবে কাজ করতে? এর উত্তর নির্ভর করে আমাদের শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশাগত স্বীকৃতির ওপর। আমাদের আত্মমূল্যায়নের, প্রস্তুতির ও অঙ্গীকারের উপর। একটি স্বাস্থ্যবান, নিরাপদ ও টেকসই বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন বাস্তবমুখী শিক্ষা, অর্থনৈতিক চর্চা, প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা, গবেষণাভিত্তিক নীতিনির্ধারণ এবং সমাজে প্রাণিচিকিৎসকদের অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি।”
সালাউদ্দিন/সাএ
সর্বশেষ খবর