
কক্সবাজারের মহেশখালীর গোরকঘাটার সাবিনা ইয়াসমিন তখন মাত্র সাত বছরের শিশু। “হঠাৎ বিশাল এক ঢেউ এসে সব গুলিয়ে দিল। বাবার হাতটা ধরে ছিলাম, কিন্তু ঢেউ ছিনিয়ে নিল। আজও আমি তাকে খুঁজে ফিরি, অথচ কোথাও তো কোনো কবরও নেই!”- বলে থেমে যান সাবিনা। চোখ ভিজে ওঠে তার।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নিয়েছিল লক্ষ প্রাণ, ভেঙে দিয়েছিল লাখো পরিবার। সেই রাতের আর্তনাদ ৩৫ বছরপরও থেমে যায়নি- আজও কাঁদে উপকূল, আজও ঢেউয়ের শব্দে ঘুম ভেঙে চমকে ওঠেন সেই ভয়াল রাতের বেঁচে থাকা মানুষগুলো।
কুতুবদিয়ার ধুরুং চরপাড়ার মোহাম্মদ হোসেন তখন তরুণ। এক ঘরে ছিল মা-বাবা, তিন ভাই ও দুই বোন। “ঝড় আমরা দেখেছি আগেও, কিন্তু সেই রাতে সবকিছু এক মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেল। আজও কারও মরদেহ পাইনি। কেবল মনে পড়ে- বাড়ি ভাঙছিল, মানুষ ভাসছিল, ঝড়ের শব্দ পেরিয়ে যাচ্ছিল কান্না।” তার কণ্ঠে তীব্র হাহাকার।
কুতুবদিয়ার নুরুল ইসলাম তখন চৌদ্দ বছরের কিশোর। সেই রাতে ছোট ভাইয়ের হাত ধরে বাড়ি ছাড়েন। “স্রোত এমন ভয়াবহ ছিল যে আমাকে ছিটকে ফেলে দেয়। তিনি বলেন, ভাইয়ের শেষ চিৎকারটা আজও কানে বাজে- ‘ভাইয়া’ ৩৫ বছরেও সে শব্দ ভুলতে পারি না।”
পেকুয়ার হালিমা খাতুন সেই রাতে হারান তার দুই সন্তান- রিফাত ও রুমাইনা। তারা বলেন, “ভোরে পানি নামার পর ওদের পাশাপাশি পড়ে থাকতে দেখি। বুকের ওপর রেখে বসে ছিলাম। তখনও আমি মা ছিলাম, এখনো মা- ওরা আর কোনো শব্দ করে না।”
ঢাকায় থাকা মোজাম্মেল হকের মন আজও কুতুবদিয়ায়। সেই রাতে হারিয়েছেন মা-বাবা, স্ত্রী ও ছেলেকে। তিনি বলেন, “এক সময় আমরা দশজন ছিলাম, এখন আমি একা। বাতাসের শব্দেই মনে হয় তারা কথা বলে। এই শূন্যতা কোনো দিন পূরণ হবে না।”
পেকুয়ার রহিমা বেগমের কাছে সেই রাত যেন মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ কিছু। তিনি বলেন, “আমার ঘরে আলো ছিল তিন সন্তান। সেদিন রাতে সব নিভে গেল। আমি বেঁচে থাকলেও ভেতরে সব মরে গেছে।”
উপকূলজুড়ে আজও বাজে শোকসংগীত
উত্তর গোমাতলীর রাজঘাটের বাঁধ এখনও ভাঙা, জেটি নড়বড়ে। এলাকাবাসীর শঙ্কা- আরেকটা ২৯ এপ্রিল এলে এবার আর কেউ রক্ষা পাবে না। প্রতি বছর উপকূলের মানুষ ভোরবেলা দোয়া করেন, কবরের পাশে বসে গল্প শোনান মৃতদের, শিশুদের শেখান সেই রাতের ভয়াল ইতিহাস।
প্রস্তুতি এখনো অপূর্ণ সরকারি হিসেবে কক্সবাজার জেলায় ৫০০টিরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা- অনেক কেন্দ্রই রয়েছে দূরবর্তী, সংযোগবিচ্ছিন্ন বা দুর্বল কাঠামোর। উপকূলবাসীর আক্ষেপ, “আমরা সচেতন হয়েছি, কিন্তু প্রকৃতি তো কখনও আগাম সময় দেয় না। পুরনো বেড়িবাঁধগুলো যদি মেরামত না হয়, তবে বিপদের পুনরাবৃত্তি অনিবার্য।”
ভয়াল ২৯ এপ্রিল কেবল একটি দিন নয়- এটি উপকূলবাসীর হৃদয়ে গেঁথে থাকা এক গভীর ক্ষত। যারা হারিয়ে গেছেন, তারা আর ফিরে আসবেন না। তবু এই দিনে তারা ফিরে আসেন স্মৃতিতে, ছবিতে, বাতাসে- ফিরে আসে ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে, বুকের গভীরে জমা কান্নার সুরে। তাই, ৩৫ বছর পরও থামেনি সেই রাতের আর্তনাদ। উপকূল আজও কাঁদে, আজও বুকে চেপে রাখে অগণিত না বলা গল্প। এমনটাই বলছেন উপকূলবাসী।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, “নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, মানুষ এখন আগেভাগেই নিরাপদ স্থানে সরেন। তবে প্রতিরক্ষা অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করা এখন সময়ের দাবি।”
রার/সা.এ
সর্বশেষ খবর