১০০ আসনে প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত, বাদ পড়ার শঙ্কায় অনেক প্রভাবশালী নেতা

প্রকাশিত: ২৪ মে ২০১৮, ০৮:১৫ এএম

রেজাউল করিম প্লাবন: দশম সংসদের ২৩৪ দলীয় এমপি থেকে ১০০ প্রভাবশালী, ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতার নাম ফের মনোনয়নের জন্য স্থির করেছে আওয়ামী লীগ। আরও ৫০ এমপির আমলনামা যাচাই-বাছাই শেষে মনোনীতদের তালিকায় স্থান দেবেন দলের হাইকমান্ড।

বাকিদের ভাগ্যে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন জুটছে না বলেই আভাস দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন পার্টির নীতিনির্ধারকরা। দল ও সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ণকারীরা আছেন বাদ পড়ার তালিকায়। এসব আসনে সন্ধান করা হচ্ছে নতুন মুখ।

এছাড়া অন্যান্য ও জোট বন্ধুদের ৬৬ আসনেও বরাবরের মতো দলীয় প্রার্থী দেবে শাসক দল। অক্টোবরের আগেই ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত হবে। সংসদ নির্বাচনের তফসিলের পরপরই প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হবে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ‘গডফাদার’ ও ‘জনবিচ্ছিন্ন’ সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেসব এমপির বিরুদ্ধে এলাকায় খুন, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, ঋণ খেলাপি, টেন্ডার-চাঁদাবাজিসহ দখলদারিত্বের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে তারা কেউ মনোনয়ন পাবেন না।

এ ধরনের বিতর্কিত এমপি শনাক্তে সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। অনেকের রিপোর্ট এখন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। এর বাইরেও দলের সাংগঠনিক সফরে থাকা ১৫টি টিমের হালনাগাদ তথ্যও সংযোজিত হচ্ছে মূল তালিকায়। দলীয় সভাপতির নির্দেশে সাংগঠনিক সম্পাদকরা ও কয়েকটি বিশেষ টিম আসন ধরে ধরে প্রার্থীদের বায়োডাটা সংগ্রহ করছেন। সেগুলো পর্যালোচনা করে তালিকা তৈরি হচ্ছে।

তারা আরও বলেন, ইতিমধ্যে অভিযুক্তদের তালিকার কাজ শেষ হয়েছে। অভিযুক্তদের অনেকেই আইনের আওতায় আছেন। বাকিদের বিরুদ্ধেও আইনি প্রক্রিয়া চলছে। বিতর্কিতদের অধিকাংশই আইনি জটিলতায় বাদ পড়বেন। চাইলেও তাদের মনোনয়ন দেয়া সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে বর্তমান সংসদের কমপক্ষে ১০০ এমপি বাদ পড়ার তালিকায় আছেন বলেও জানায় আওয়ামী লীগের এ নির্ভরযোগ্য সূত্রটি।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সংসদীয় মনোনয়নের বোর্ডের অন্যতম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা ১০০’র মতো আসনে এমপি প্রার্থী চূড়ান্ত করেছি। এসব আসনে মনোনীত প্রার্থীদের গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। বাকি ২০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্তের কাজ চলছে। আগামী ঈদের পরেই এসব আসনের বিপরীতে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শেষ হবে। তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ৩০০ আসনের প্রার্থীর নাম প্রকাশের কোনো সম্ভাবনা নেই।

আওয়ামী লীগ জরিপ টিমের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গত দেড় বছর ধরে ৩ মাস পরপর মাঠ জরিপ করছেন। সেখানে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আলোচিত-সমালোচিত মন্ত্রী-এমপিদের নাম ওঠে এসেছে।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে- এসব আসনে ফের তাদের মনোনয়ন দেয়া হলে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অসাধ্য হবে। এসব মন্ত্রী-এমপিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের কারও বিরুদ্ধে এলাকায় জনপ্রিয়তা হ্রাস, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, অনেকের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, অনৈতিকভাবে বিত্তবৈভব গড়ার মতো অভিযোগ আনা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে আনা হয়েছে সন্ত্রাস ও দলীয় কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগ।

দলীয় নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এমনকি বিএনপি-জামায়াত নেতাদের নিয়েও নিজস্ব বলয় সৃষ্টির অভিযোগও আছে কারও বিরুদ্ধে। আর এসব কারণে প্রার্থী বাছাইয়ে সময় নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দুই নেতা যুগান্তরকে জানান, দলের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রতিটি সভায় বিতর্কিতদের মনোনয়ন না দেয়ার কথা বলেছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলে কে কি করেন, কার জন্য দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে সে তালিকাও আছে দলীয় সভাপতির কাছে। জনবিচ্ছিন্ন ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারীদের শেষ সুযোগও দিয়েছেন তিনি। এরপরও নিজেদের শোধরাতে পারেননি বিতর্কিত অনেক এমপি।

৩১ মার্চ দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় পুনরায় বিতর্কিত নেতাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। ওই সব এলাকায় ক্লিন ইমেজ ও জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন দলের সভাপতি।

একই বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে সংশোধনের কথা বলছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদের প্রার্থী নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে বুধবার যুগান্তরকে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান। তিনি বলেন, প্রতি নির্বাচনের আগে এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই বাদ পড়েন, তারা মনোনয়ন পান না। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। জনপ্রিয়তা, দলে সম্পৃক্ততা ও কাজের দক্ষতা দেখে দলীয় মনোনয়ন দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এই তিন ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জনে যারা ব্যর্থ হবেন তারা এমপি মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়বেন।

তিনি বলেন, বিগত এক বছর থেকে মনোনয়ন বাছাইয়ের কাজ চলছে। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর দলীয় প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করবে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারক সূত্রে কথা বলে জানা যায়, গ্রিন সিগন্যাল দেয়া ১০০ আসনের প্রার্থীরা ইতিমধ্যে নিজ নিজ এলাকায় কাজ করছেন। দল ও সমাজে কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রাখা এসব নেতা প্রতিপক্ষেরে যে কোনো নেতার চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন। আগামী নির্বাচনে তৈরি থাকার বিষয়ে এমন নেতাদেরই গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নীতিনির্ধারকদের দেয়া তথ্য মতে- ঠাকুরগাঁও-১, দিনাজপুর-১, দিনাজপুর-২, দিনাজপুর-৩, দিনাজপুর-৫, নীলফামারী-২, লালমনিরহাট-১, লালমনিরহাট-২, রংপুর-৪, গাইবান্ধা-২, বগুড়া-১, বগুড়া-৫, নওগাঁ-১, রাজশাহী-৪, রাজশাহী-৬, নাটোর-৩, সিরাজগঞ্জ-১, সিরাজগঞ্জ-২, সিরাজগঞ্জ-৬, পাবনা-৫, কুষ্টিয়া-৩, ঝিনাইদহ-২, ঝিনাইদহ-৪, যশোর-৫, মাগুরা-২, বাগেরহাট-১, খুলনা-১, সাতক্ষীরা-৩, সাতক্ষীরা-৪, বরগুনা-১, পটুয়াখালী-২, ভোলা-১, ভোলা-২, ভোলা-৩, ভোলা-৪, বরিশাল-১, বরিশাল-২, ঝালকাঠি-২, টাঙ্গাইল-১, টাঙ্গাইল-৫, টাঙ্গাইল-৮, জামালপুর-৩, শেরপুর-২, ময়মনসিংহ-১, ময়মনসিংহ-১০, কিশোরগঞ্জ-১, কিশোরগঞ্জ-৪, কিশোরগঞ্জ-৫, কিশোরগঞ্জ-৬, মানিকগঞ্জ-২, মানিকগঞ্জ-৩, মুন্সীগঞ্জ-৩, ঢাকা-২, ঢাকা-৩, ঢাকা-৯, ঢাকা-১০, ঢাকা-১১, ঢাকা-১২, ঢাকা-১৩, ঢাকা-১৪, গাজীপুর-১, গাজীপুর-২, গাজীপুর-৪, গাজীপুর-৫, নরসিংদী-১, নরসিংদী-৪, নারায়ণগঞ্জ-১, নারায়ণগঞ্জ-২, নারায়ণগঞ্জ-৪, রাজবাড়ী-১, রাজবাড়ী-২, ফরিদপুর-১, ফরিদপুর-৩, গোপালগঞ্জ-১, গোপালগঞ্জ-২, গোপালগঞ্জ-৩, মাদারীপুর-১, মাদারীপুর-২, শরীয়তপুর-১, শরীয়তপুর-৩, সুনামগঞ্জ-৩, সিলেট-৩, সিলেট-৬, হবিগঞ্জ-২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, কুমিল্লা-২, কুমিল্লা-৩, কুমিল্লা-৪, কুমিল্লা-৫, কুমিল্লা-৯, কুমিল্লা-১০, কুমিল্লা-১১, চাঁদপুর-২, চাঁদপুর-৪, নোয়াখালী-৪, নোয়াখালী-৫, চট্টগ্রাম-১, চট্টগ্রাম-৭, চট্টগ্রাম-১২, চট্টগ্রাম-১৩ ও কক্সবাজার-৩ আসনের প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রাখা হয়েছে।

প্রার্থী বাছাইয়ে এবার কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না জানিয়ে আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন জরিপ সংস্থার পাশাপাশি দেশের সুশীল সমাজ ও দলের একটি টিম দিয়েও প্রার্থীদের জরিপ কাজ করছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটি মাঠপর্যায়ে গিয়ে প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন নেত্রী (শেখ হাসিনা) নিজেই।

তিনি বলেন, দলে যারা বিতর্কিত ও বিভিন্ন সময়ে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন তারা এবার মনোনয়ন পাবেন না। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে এসব আসনে নতুনদের সন্ধান করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে জয় নিশ্চিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের আরেকটি সূত্র বলছে, নির্ধারিত ১০০ আসনের বাইরে থাকা আসনগুলোর প্রত্যেকটির বিপরীতে তিনজন করে প্রার্থীর নাম নিয়ে তালিকা তৈরি হচ্ছে। অনেক আসনে এ তিনজনের তালিকায় বর্তমান এমপিদের নাম নেই। নবীন ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, পেশাজীবী নেতা, সাবেক পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা, আমলা ও রাজনৈতিক নেতা এ তালিকায় আছেন। বিএনপির বিভিন্ন আসনের সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু নেতাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা সংসদ সদস্যদের তালিকা ধরে ধরে কমপক্ষে ১০০ বিতর্কিত এমপির নাম তুলে এনেছেন, যাদের আসনে উল্লিখিত নতুনদের জনপ্রিয়তার মাপ কাঠিতে মনোনয়ন দেয়া হবে। আর এসব আসনেই সরকারি, বেসরকারি জরিপ সংস্থা ও দলের সাংগঠনিক টিম প্রার্থী বাছাইয়ে বেশি বেশি করে কাজ করছে। সূত্র: যুগান্তর।

বিডি২৪লাইভ/এমআর

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: