হারিয়ে যাচ্ছে নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁতশিল্প

প্রকাশিত: ১২ এপ্রিল ২০১৫, ০৯:১৪ পিএম

নরসিংদী প্রতিনিধি:

নরসিংদীর তাঁতের লুঙ্গী ও বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে যান্ত্রিক চালিত পাওয়ালুমের কাছে হার মারতে হচ্ছে হস্তচালিত তাঁতশিল্পের অতীত ঐতিহ্য। ব্রিটিশ-বাংলা থেকে শুরু করে পাক-ভারত এমনকি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৮০’র দশক পর্যন্ত নরসিংদীর তাঁতের তৈরী লুঙ্গী ও শাড়ী সারা বাংলাদেশে মানুষের চাহিদা পূরণ করত। আর এখন জনপ্রিয় হচ্ছে পাওয়ালুমের তৈরি ব্র্যান্ডের লুঙ্গি। কালের বিবর্তনের সাথে পাল্ল¬া দিতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে নরসিংদীর এ ঐতিহ্যবাহি হস্তচালিত তাঁতশিল্প। রং ও সুতাসহ তাঁতশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও বর্তমান বাজারে তাঁতের তৈরি লুঙ্গি, গামছা ও শাড়ীর তেমন চাহিদা না থাকায় কমে গেছে এ শিল্পের কদর। বর্তমান সময়ের নতুন প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তাঁতীদের অনেকেই ছেড়েছেন বাপ-দাদার রেখে যাওয়া এ তাঁতপেশা। যারা এখনও আকড়ে ধরে আছেন এ পেশাকে, তারা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

সরেজমিন এক সময়কার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকায় তাঁতীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,এককালে নরসিংদীর তাঁতের কাপড়ের সুনাম ছিল দেশজুড়ে। বিশেষ করে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা ছিল তাঁতের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। উপজেলার প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে বুনা হতো শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা চাদর। এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে দুই-চারটি তাঁতকল ছিল না। রায়পুরা উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন ছাড়াও জেলা সদরের হাজীপুর, ঘোড়াদিয়া,করিমপুর,নজরপুর,শেখেরচর,মাধবদী,কৌলানপুর,ভাটপাড়া,ভগিরতপুর এবং পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল, পাইকশা, সানের বাড়ী এলাকায় তাঁতি হস্তচালিত তাঁতের লুঙ্গী তৈরী হতো।

এছ্ড়াা বেলাব, শিবপুর ও মনোহরদী উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য তাঁতশিল্প। তবে তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে রায়পুরা উপজেলার পরিচিতি ও সুনাম ছিল দেশজুড়ে। এখানকার তৈরি তাঁতের শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা চাদর সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন জেলায়। রায়পুরা উপজেলা সদর, আমিরগঞ্জের হাসনাবাদ, শ্রীরামপুর, হাঁটুভাঙ্গা, চরসুবুদ্ধি ও রাধাগঞ্জে গড়ে উঠা তাঁতশিল্প কেন্দ্রিক বাজারে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার কাপড় কেনাবেচা হতো। এ তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে এ উপজেলায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হাসনাবাদ তাঁতী বাজার পরে সরকারী ভাবে ১৯৮২ সালে স্থাপন করা হয় হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টার। স্থানীয় তাঁতী ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে নৌ ও রেলপথে আসা তাঁতের কাপড়ের পাইকারী ক্রেতাদের ভীড়ে মুখর হয়ে উঠতো বাজারগুলো। জেলার তাঁতীদের পেশাগত উন্নয়নে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড কর্তৃক নরসিংদী সদর উপজেলার সাহেপ্রতাবে গড়ে উঠে তাঁত প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। যেখান থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেত জেলার অসংখ্য তাঁতী। তাঁতের তৈরি শাড়ী, লুঙ্গি ও গামছার সেই সুনাম আজ শুধুই স্মৃতি।

কালের বিবর্তনে হস্তচালিত তাঁতকল বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এখন এ জেলায় উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রচালিত তাঁতে তৈরি হচ্ছে শাড়ী, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা চাদরসহ অন্যান্যসব দেশীয় কাপড়। আর এসবের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহি হস্তচালিত তাঁতশিল্প। সুতা, রংসহ তাঁতশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধি, দিনদিন বাজারে তাঁতের কাপড়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তাঁতীরা। অব্যাহত লোকসানের মুখে পড়ে বাপ-দাদার এ পেশা বদল করতে থাকেন তারা। অন্যকোন কাজ জানা না থাকায় অনেকে এখনও আকড়ে ধরে আছেন এই তাঁতপেশা। কিন্তু পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগের তুলনায় লাভজনক না হওয়ায় বিপাকে আছেন তাঁতীরা। ফলে বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের।

এছাড়া তাঁত শিল্পের উন্নয়নে প্রতিবছর তাতঁ বোর্ডের অধীনে লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ সহায়তা থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ের তাঁতীরা এসব ঋণ সহায়তা পাননা বলে অভিযোগ তাদের। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার ঐতিহ্যবাহি এই তাঁত শিল্প।

নরসিংদীর তাঁত বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে এ জেলায় মোট তাঁতীর সংখ্যা ৭ হাজার ২ শত ৪৭ জন। তাঁতের সংখ্যা ২৬ হাজার ৬শত ৯৩টি এর মধ্যে চালু আছে ১৪ হাজার ৮ শত ৪৫টি।

রায়পুরা উপজেলার চরসুবুদ্ধি ইউনিয়নের মুদাফতপাড়ার তাঁতী জয়নাল মিয়া বলেন, অনেকটা নিরুপায় হয়েই বাপ-দাদার এই পেশা আকড়ে আছি। বর্তমান বাজারে সুতা ও এই শিল্পের প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দামও অনেক বেশি। সে তুলনায় বাজারে চাহিদা ও দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই পুঁজি হারিয়ে তাঁত ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেকে।

হাইরমারা গ্রামের মঙ্গল মিয়া বলেন, মূলত প্রতিযোগিতার কাছে আমরা পরাজিত হয়ে যাচ্ছি। আমাদের তৈরি তাঁতবস্ত্রের আগের মত কদর নাই। অন্য কোন কাজ নাই বিধায় বেকার থাকার চেয়ে কোন রকম এ পেশায় লেগে আছি।

নিলক্ষা বীরগাঁও গ্রামের অপর এক তাঁতী রব মিয়া বলেন, লাভজনক না হওয়ায় মালিকরা এই ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে আমরা তাঁতীরা বেকার হয়ে পড়ছি। ফলে পরিবার নিয়ে মানবতের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাঁত ছেড়ে অনেকে রিকশা, অটোরিক্সা চালক, আবার অনেকে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে বেঁচে আছে।

তাঁতবোর্ড নরসিংদীর ভারপ্রাপ্ত লিয়াজো অফিসার মো: এবি সিদ্দিক বলেন, দফায় দফায় সুতার মুল্য বৃদ্ধি ও পাওয়ারলুম শিল্পের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এ শিল্প বিলুপ্ত হচ্ছে। তবে আমরা প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা দিয়ে তাদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০১ জন তাঁতীকে ৩ কোটি ২২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করেছি।

সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও সুতার মুল্য কমানো গেলে আবারো তাঁত শিল্প তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: