তসলিমায় অনুপ্রাণিত হয়ে ছেলে থেকে মেয়ে হল যুবকটি!
সম্প্রতি আলোচিত-সমালোচিত ও নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন তার ফেসবুক ইনবক্সে পাঠানো এক যুবকের ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে ওঠার গল্প ফেসবুকে শেয়ার করেছে যা বিডি২৪লাইভের পাঠকদের উদ্দেশ্যে হুবহু তুলে ধরা হল:
--‘আমি আপনাকে দিদি, আপু বা ম্যাম কোনটাই ডাকব না। আপনি আমার কাছে শুধুই তসলিমা নাসরিন। আমার ভেতরের রিয়েল আমিটার স্রষ্টা আপনি। হ্যাঁ, আপনি। কারণ, আমি ছিলাম এক কনজারভেটিভ মুসলিম ফ্যামিলির ছেলে। আমার ভেতর সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল নারী স্বত্বা। ছোটবেলায় সবাই মেয়েলি, মেয়েমানুষ বলে টীজ করতো বলে সেই টীজিং থেকে বাঁচতে বড় হবার সাথে সাথে আর্টিফিশালি নিজেকে ছেলে হিসেবে প্রেজেন্ট করতে থাকলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছিলাম আমার আমিটাই। আমার ভেতরের সেই নারী স্বত্বা স্ট্রংলি উঁচু করে দাঁড়ালো আপনার লেখায় ইন্সপায়ার্ড হয়ে। আপনার সব লেখা পড়তাম একজন নারী হিসেবে। আপনার লেখা পড়তে পড়তে ভুলেই গেছি আমি ফিজিক্যালি একজন ছেলে। নারী হয়ে জন্মিনি এ তো আমার ভুল নয়, কিন্তু নারীত্বের জন্য আমার লড়াই আমার অহংকার। নিজেকে আমি কখনো হোমোসেক্সচুয়াল ছেলে বা ট্রান্সসেক্সচুয়াল থার্ড সেক্স হিসেবে ভাবিনি বা ভাবতে পারি নি। কারণ, মনেপ্রাণে আমি একজন নারী। অভিজিৎদার ‘সমকামিতা’ বইটির ট্রান্সসেক্সচুয়াল চ্যাপ্টারের সেক্স চেইঞ্জ ব্যাপারটা ভালোভাবে পড়ে সিদ্ধান্ত নিই, আমি সেক্স চেইঞ্জ করে পরিপূর্ণ নারী হবো। যা বিশ্বাস করি তা জীবন দিয়ে ধারণ-লালন করাই সত্যিকারের সততা-- তা আপনার কাছ থেকেইশিখেছি।
কনজারভেটিভ মুসলিম ফ্যামিলিতে জন্মেছি, বড় হয়েছি কিন্তু আপনার লেখা পড়ে ও নিজের হিউম্যানিজম- ফ্যামিনিজম-হিউম্যান রাইটস বোধ থেকে সকল ধর্মমুক্ত-নিরীশ্বরবাদী-মানবতাবাদী-নাস্তিক হয়েছি। এ জন্মে আমি আমার মা,ফ্যামিলি,রিলেটিভ, এলাকার লোকদের দুই চোখের বিষ। আর জানেন তো এখন বাংলাদেশের কী অবস্থা। আমার বাবা বেঁচে থাকলে বোধহয় আমাকে আল্লাহ্র নামে কতল করতো। আপনার লেখা পড়লে মনে হয় যেন আমারই কথা।
কোইনসিডেন্টলি নারীবাদ, নাস্তিকতা, মানবতাবাদ, মানবাধিকার, বাংলা ভাষা, বাঙ্গালিয়ানা, বাংলাদেশ সব চিন্তার সাথে আমার সব চিন্তা মিলে যায়। দৃষ্টিভঙ্গির সিমিলারিটির কারণেই বোধহয় এমনটা মনে হয়। মাঝেমাঝে আমি ফান করে নিজেকে অজাত বলি। কারণ, ছেলে হয়ে জন্মে নারী হবার লড়াই, গোঁড়া মুসলিম ফ্যামিলিটিতে জন্মে স্ট্রংলি নাস্তিক হওয়া। আরেকটি ইম্পর্টেন্ট ব্যাপার যা বলা হয়নি, আমি একাডেমিক স্টাডিতে কোনোদিন ইন্টারেস্টেড ছিলাম না। ভীষণ বোরিং লাগতো। কিন্তু রেজাল্ট ভাল ছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশান টেস্টে ভালো রেজাল্ট করে বিবিএর দামি দামি সব সাবজেক্ট না নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান্সে ভর্তি হই হিউম্যান রাইটস নিয়ে কাজ করবো বলে। যদিও আমার সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল, টিপিক্যাল মা-বাবার মত আমার মা-বাবাও চেয়েছিলেন আমাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। কিন্তু সাইন্স পড়তে আমার একদমই ভালো লাগতো না। আমার মন পড়ে থাকতো মানুষের জীবন-মনন-আর্ট-কালচারের দিকে।
আপনার লেখা দ্বারা আমি আগে থেকেই ইনফ্লুয়েন্সড ছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর অরুন্ধতী রায়ের লেখা (আমেরিকার মনো পোলার গ্লোবালাইজেশানের এগেইন্সটে রিয়েল হিউম্যান রাইটসের পারসপেকটিভ থেকে ওনার সব ক্ষুরধার লেখা।) দ্বারাও খুব ইনফ্লুয়েন্সড হলাম। এরপর থেকে ইউনিভার্সিটির আমেরিকার দালালি করা সব সিলেবাস, ইসলামিস্ট টিচারদের ক্লাস সব ভীষণ বোরিং লাগতো। কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারতাম না। একসময় স্ট্রংলি ডিসিশান নিলাম ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দেবো, দিলামও। এরপর নিজের মতো করে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সোসাইটি, হিস্ট্রি,ডিফরেন্ট ইজমগুলো নিয়ে থিসিস করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আনবিলিভিবল হলেও সত্যি যে আমি খুব কনফিডেন্টলি বলছি, আমি সমাজ বিশ্লেষণের প্রকৃত কারেক্ট থিউরি এবং রিয়েল সায়েন্টিফিক হিউম্যানিজম ডিসকভার করলাম। কারণ, মার্কসের কমিউনিজম বা সোশ্যালিজমকে কখনোই আমার কাছে পুরোপুরি মানবমুক্তি,নারীমুক্তি অথবা হিউম্যান রাইটসের মনে হয়নি। আমি যা ডিসকভার করেছি, তা একবার পাবলিশ করতে চাই, বিচ্ছিন্নভাবে লিখে লিখে নয়। এজন্য আমি ব্লগ বা ফেসবুকে কিছু বিচ্ছিন্নভাবে লিখি না। এজন্য আপনার সাথে কথা বলা আমার খুব প্রয়োজন’’।
মেয়েটির সংগে আমার কথা হয়নি এখনও। ওকে মেয়েই বলছি। কারণ ও নিজেকে মেয়ে বলেই মনে করে। একজন মানুষই জানে, সে নিজে কী, ছেলে না মেয়ে নাকি অন্য কিছু। সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের সমান। পুরুষলিঙ্গের যেমন অধিকার, নারী লিঙ্গেরও একই অধিকার,উভলিঙ্গেরও একই। হেটারোসেক্সুয়াল বা বিপরীতকামী বা বিষমকামীদের অধিকার যতটুকু, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদেরও ততটুকুই। এতে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের মানবাধিকারে বিশ্বাস নেই। যারা সমকামী আর রূপান্তরকামীদের নিগ্রহ করছে, যারা সিসজেণ্ডার আর বিপরীতকামী ছাড়া, অর্থাৎ পুংলিঙ্গের পুরুষ ও নারী-লিঙ্গের নারী ছাড়া আর সবাইকে, পুরুষ আর নারীর কাম ছাড়া আর সব কামকে অস্বাভাবিক আর প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করছে---তাদের শিক্ষিত করা, সচেতন করা, মানুষ করা অত্যন্ত জরুরি। অকাটমূর্খের সংখ্যা বেশি বলেই তাদের মূর্খামি মেনে নিতে হবে,গণতন্ত্রও বলে না। গণতন্ত্র সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে। সমকামী বলে বা রূপান্তরকামী বলে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়, অধিকার কিছু কম জোটে কোথাও, তবে তা নিতান্তই বিষমতন্ত্র,গণতন্ত্র নয়।
রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চলছে চারদিকে।ওরা চাইছে নিজের জেণ্ডার নিজের নির্ণয়ের অধিকার এবং সেই জেণ্ডারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার অধিকার, রূপান্তরকামী বলে নিগৃহীত না হওয়ার অধিকার, নিজের জৈবলিঙ্গকে পরিবর্তন করার অধিকার, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার অধিকার, যৌনসঙ্গমের অধিকার, বিয়ে করার অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার। যে সমাজে আজও নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে লাঞ্ছিত হতে হয়, সে সমাজে সমকামী আর রূপান্তরকামীদের অধিকারের জন্য আরও দীর্ঘ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হবে, অনুমান করতে পারি। মানুষ প্রজাতি সেদিন সত্যিকার সভ্য হবে, যেদিন কোনও মানুষকেই নিজের মৌলিক অধিকারের জন্য আর লড়াই করতে হবে না।
সমকামী আর রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার যেন লঙ্ঘন না হয়, তা লক্ষ রাখার দায়িত্ব সমকামী আর রূপান্তরকামীদেরই শুধু নয়,সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপরীতকামীদেরও। মানবতার জন্য সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। সবাই যদি এগিয়ে নাও আসে, তাহলেও ক্ষতি নেই। লক্ষ লক্ষ লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। ইতিহাস বলে,হাতে গোণা কিছু সাহসী আর স্বপ্নবান মানুষই সমাজ বদলায়।
বাংলাদেশ ফৌজদারি আইনের ৩৭৭ ধারাটি সমকামের বিরুদ্ধে। এর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অথবা ১০ বছরের কারাদণ্ড, এবং জরিমানা। একসময় সমকামীরা পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিত, রংধনুর রঙ্গে নিজেদের সাজিয়ে। কিন্তু জুলহাস মান্নান আর মাহবুব তনয়ের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কেউ আর সাহস পায়নি পথে নামতে। পথে নামা অবশ্য আগেও নিরাপদ ছিলো না। গত বছর রংধনু র্যা লি থেকে ৪ জন সমকামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ওদের অপরাধ, ওরা সমকামী। দুদিন আগে, ২৭ জনকে সমকামী সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ একটি মৌলবাদি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে একাত্তরে, কিন্তু আজও দেশটি সভ্য হলো না। সভ্য হলে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ পরষ্পরের সম্মতিতে কী ভাবে যৌনসঙ্গম করবে – এ নিয়ে মাথা ঘামাতো না, এর বিরুদ্ধে আইন তৈরি করতো না। সব ধর্মই সমকামের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বলেছে। ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে সমকামীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা কি ঠিক? মানুষের জন্য ধর্ম নাকি ধর্মের জন্য মানুষ? আমি তো মনে করি মানুষের জন্য ধর্ম। মানুষের মঙ্গলের জন্য ধর্ম, অমঙ্গলের জন্য নয়। যে দর্শনকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, নারীর সমানাধিকার, মানবাধিকার —সবই খর্ব হয়, সেই দর্শনের মধ্যে গন্ডগোল আছে। কোনও দর্শন যদি দীর্ঘ দীর্ঘ কাল বা অনন্ত কাল টিকে থাকতে চায়, তবে টিকে থাকার একমাত্র উপায় – উদার হওয়া।
বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এডিটর ইন চিফ: আমিরুল ইসলাম আসাদ
বাড়ি#৩৫/১০, রোড#১১, শেখেরটেক, ঢাকা ১২০৭
ই-মেইলঃ [email protected]
ফোনঃ (০২) ৫৮১৫৭৭৪৪
নিউজ রুমঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯১
মফস্বল ডেস্কঃ ০১৫৫২৫৯২৫০২
বার্তা প্রধানঃ ০৯৬৭৮৬৭৭১৯০
মার্কেটিং ও সেলসঃ ০৯৬১১১২০৬১২
ইমেইলঃ [email protected]
পাঠকের মন্তব্য: