কন্যা শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে!

প্রকাশিত: ০১ অক্টোবর ২০১৪, ০৫:০২ এএম

শফিকুল ইসলাম খোকন

আজ ৩০ সেপ্টেম্বর ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’। প্রতি বছর এ দিসবটি পালন করে থাকে দেশের সরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন সংগঠন। শিশুরা হচ্ছে জাতির ভবিষ্যত এবং একই সাথে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশ। শিশুর প্রতি ব্যবহারে সর্তকতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বিশ্বশিশু পরিস্থিতিতে পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থা বিরাজমান থাকা সত্ত্বেও বর্তমান বিশ্ববাসীদের মধ্যে এক জায়গায় একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়, যা হচ্ছে শিশু অধিকার সর্ম্পকে পূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে আরো অনেক বেশি সচেতনতা। শিশুর প্রতি দায়িত্ববোধ এখন আর শুধু নীতিবোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়-বরং তা ক্রমবর্ধমান হারে বৃহত্তর সামাজিক ও আইনানুগ বাধ্যবাধকতার আওতায় চলে আসছে।

'শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কর্ণধার', 'শিশুদের হাতেই আগামীর পৃথিবীর ভার, শিশুরাই আমাদের অহংকার' ইত্যাদি কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান হয়তো ঝালাপালা হয়ে যায়। কান ঝালাপালা হোক আর যাই হোক কথাগুলো কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়। প্রতি বছর শিশুদের নিয়ে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস, কন্যা শিশু দিবস পালন করা হচ্ছে। তারপরেও শিশুর প্রতি বৈষম্য আর অধিকারের বিষয়টি আমরা ভুলে যাই। এক দলা কাদামাটি আর একটা শিশুতে আসলে মৌলিক কোনোই পার্থক্য নেই। নরম কাদামাটিতে যেমন ইচ্ছেমতো একজন কারিগর যা ইচ্ছে তাই বানাতে পারেন, ঠিক একইভাবে একটি শিশুকে একই প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।

আদূরীর খবর আমরা সবাই জানি। আদুরীকে কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তাও আমরা জানি। এভাবে আদুরীর মতো দেশের কত কন্যা নির্যাতন হয় তা হয়তো সব পত্রিকার পাতায় আসে না বা জানতেও পারি না। কন্যা শিশুর অধিকারের দিকে না তাকিযে আমরা বিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করছি না। বয়স বার-তের পার না হতেই এদের কৈশোর শেষ হয়ে যায়। এরা হয় অন্যের ঘরের বউ। আটকে পড়ে সংসার নামক এক অদৃশ্য বেড়াজালে।অল্পবয়সে মা হওয়াসহ নানা রকম রোগে ভুগে তারুণ্যের আগেই বৃদ্ধ হয়ে যায় ওরা। বাল্যবিবাহের পরিণতিতে শুধু শিশু, অল্পবয়সী নারী বা তার পরিবারই আক্রান্ত হয় না, অপুষ্টি ও দুর্বল ভবিষ্যত প্রজন্মের উত্তরাধিকারীও হয় এসব এলাকা।

সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ঘোষণায় বা সনদে বলা হয়েছে। কিন্তু সমঅধিকারের কথা বলা থাকলেও একটা বিরাট বৈষম্য চোখে পড়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পরিবারে, কলকারখানায়, কৃষিতে, ব্যবসায়, প্রশাসনে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে আজও পৃথিবীর প্রতিটি কোণে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে কন্যা শিশুর অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছেনা। শিশু সুরক্ষার জন্য শিশু নীতিমালা, শিশু অধিকার আইন ইত্যাদি করা হলেও এখনো রয়েছে কন্যা শিশুর প্রতি বৈষম্য।

শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রণীত হয় শিশু আইন-১৯৭৪ যা যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে শিশু আইন-২০১১ রূপে প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (Convention on the Rights of the Child, CRC) ১৯৮৯-এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশু নীতিও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু এ বাণীটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে! আর ওই শিশু যদি নিজের না হয়ে থাকে অর্থাত্ শিশু শ্রমিক হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই। শিশুশ্রম রোধ ও তাদের সুরক্ষায় ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। ভূরি ভূরি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে কাগজে-কলমে। তবু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে অহরহ। বিভিন্ন কল-কারখানা, ইমারত নির্মাণ, দিনমজুরি, রিকশা, ঠেলা, ভ্যান চালানোসহ বিভিন্ন শ্রম কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থ সঙ্কটে পড়ে এমন অনেক শিশুকেই শ্রমে নিয়োজিত করছেন দরিদ্র অভিভাবকরা।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০-১৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্য বিবাহের শিকার হয়। সেভ দ্যা চিলড্রেনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

বিবাহের মাধ্যমেই পরিবার সৃষ্টি হয়। বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের দাম্পত্য জীবন শুরু করার আইনগত ভিত্তি হলো বিবাহ। বাল্য বিবাহ নারীর আত্ম-উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মনোসামাজিক উন্নয়ন সহ নারীর সার্বিক উন্নয়নে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বাল্যবিবাহ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনেও সহায়ক হয়। যেমন, শিক্ষার আলো এবং স্বাস্থ্যগত কারণে অল্প বয়সের মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়, সুতরাং পরিবার সম্পর্কে তার ধারণা না থাকায় স্বাভাবিক বিষয়। ফলে একদিকে সে স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে বুঝে উঠার আগেই সংসার এবং পরিবারের ভারে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির থেকেও তার উপর চাপের সৃষ্টি হয়, শুরু হয় অশান্তি, পারিবারিক কলহ, এবং সর্বোপরি পারিবারিক নির্যাতন। আর এই পারিবারিক নির্যাতনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হয় পরিবারে, বিশেষ করে শিশুরা ভোগে নানা মানসিক অশান্তিতে। এতে তাড়া লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়, পরিবারের প্রতি জন্মে নানারকম অনীহা, ফলে তাড়া পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নানারকম অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে। বাল্য বিবাহের শিকার ছেলে ও মেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের মত মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হয়, যা তাকে তার সারাজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ করে।

শিশুরা আমাদের ভবিষ্যত্, শিশুরা আমাদের অহঙ্কার, শিশুরা আমাদের গর্ব। এই ভবিষ্যত্ প্রবক্তাদের চোখে-মুখে যদি আমরা আলোর রেণু এঁকে দিতে চাই, তাহলে সবার আগে তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে। তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে অনুকূল পরিবেশে। আর আমরা যদি তাদের সেই শিশুবান্ধব পরিবেশ উপহার দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা যত স্বপ্নই তাদের ঘিরে দেখি না কেন, সব স্বপ্ন বরবাদ হয়ে যাবে, যা আমরা অবশ্যই কখনও চাইব না। একটি শিশুর চোখে সব সময় সবরকম সম্ভাবনার বারুদ ফিনকি দেয়। সেই বারুদে কেবল আগুন ঢেলে দিতে হবে, যাতে তারা তাদের মেধা ও মননকে সঠিক জায়গায় নিয়ে লালন-পালন করতে পারে। মানুষের মৌলিক অধিকার-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা, শিক্ষা-এই পাঁচটি বিষয়কে যদি আমরা পুরোপুরিভাবে শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা যা চাই তা পাওয়াটা বোধ করি খুব কঠিন হবে না।

২০১১ সালের জাতীয় শিশুনীতির ৪ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক সনদগুলোর আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণ। শিশু দারিদ্র্য বিমোচন। শিশুর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ। কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ। শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ ও মতামত গ্রহণ।’ আমরা দেখেছি, আইন ও নীতিমালা অনেকাংশে শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবে সেটি আইন ও নীতিমালার আলোর মুখ দেখে না। আমরা দেখেছি, সম্প্রতি আলোচিত গৃহশ্রমিক আদুরী নির্যাতনের ঘটনা। আদুরীকে নিয়ে আমরা নীতিমালা অনুযায়ী কতটুকু কাজ করতে পেরেছি? আদুরীর মতো প্রতিদিন শিশুশ্রম এবং শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। যা অনেকাটাই আমরা দেখি না বা চোখে পড়ে না।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ২১৮ জন শিশু হত্যার শিকার এবং ১৯ শিশুকে ধর্ষণ এবং ১৯ শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৭৬ শিশুকে যৌন হয়রানি ও অন্যান্য কারণে আত্মহত্যা করেছে। বিভিন্ন স্থানে অপহূত ৪২ জন শিশু এখনও নিখোঁজ। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৭০ জন শিশু। বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থা এখন খুবই নাজুক। গত এক বছরে যত শিশু দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। তাই শিশুদের ওপর নির্যাতনের এই মাত্রা শিশু অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের চেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, শুধু শিশুশ্রম নয়, শিশু নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। শিশুরা দেশ ও রাষ্ট্রের সেরা সম্পদ। শিশুদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতপূর্বক সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। শিশুদের যদি আমরা ভবিষ্যত্ প্রজন্ম, অহঙ্কার, গর্ব বা সম্পদ মনে করি তাহলে শিশুদের আগলে রাখতে হবে। জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার ২০০৯ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, যা ২০১১ সালে এসে দাড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাদের ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়েছে তাদের শতকরা বর্তমান হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ।

আসুন আমরা সব শিশুকে নিজেদের সন্তানের মতো ভালোবাসি, স্নেহ-মায়া-মমতা দিয়ে ওদের বড় করে তুলি। আমাদের সব পিতা-মাতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করি। শিশুদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য আমাদেরই দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করলে এক দিন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে হবে আমাদের। কন্যা শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য সর্বাত্বক সহযোগিতা করি। আমরা আর দেখতে চাইনা, কোন কন্যা শিশু অকালে ঝড়ে পডুক, ধংস হোক সুন্দর জীবন।

লেখক [শফিকুল ইসলাম খোকন, সাংবাদিক কলামিষ্ট ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক]

বিডি২৪লাইভ ডট কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

পাঠকের মন্তব্য: